রবার্ট এল. ট্রিভার্স,
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি,
জুলাই,১৯৭৬
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
এই বইটিকে প্রায় এমনভাবে পড়া উচিৎ হবে যেন এটি কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। আমাদের কল্পনার প্রতি আবেদন সৃষ্টি করবে, এমনভাবেই বইটি পরিকল্পিত। কিন্তু এটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়: এটি বিজ্ঞান। বহু ব্যবহৃত কোনো শব্দ হোক বা না হোক, ‘গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর’ শব্দটি সঠিকভাবেই প্রকাশ করে সত্য সম্বন্ধে আমি ঠিক কি অনুভব করি। আমরা হচ্ছি টিকে থাকার বা সারভাইভাল মেশিন– রোবোট বাহন, জিন নামে পরিচিত স্বার্থপর অণুটিকে সংরক্ষিত করার নির্দেশ অন্ধভাবেই অনুসরণ করতে যা প্রোগ্রাম করা আছে। যে সত্যিটা আজো আমাকে বিস্ময়ে আপ্লুত করে। যদিও আমি বহু বছর ধরে এই সত্যটা জানি, কিন্তু কখনোই ধারণাটির সাথে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারিনি। আমার একটি আশা হচ্ছে, হয়তো অন্যদেরকেও বিস্মিত করার ক্ষেত্রেও আমি কিছুটা সফল হবো।
যখন আমি লিখছিলাম, তিনজন কাল্পনিক পাঠক আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে দেখছিলেন আমি কি লিখছি এবং এখন আমি এই বইটি তাদের প্রতি উৎসর্গ করছি। প্রথমেই সাধারণ পাঠক, যিনি এই বিষয়ে তেমন কিছুই জানেন না। তার জন্য কারিগরী শব্দগুলো আমি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছি প্রায় পুরোপুরিভাবেই এবং যেখানে আমি বিশেষায়িত কোনো শব্দ ব্যবহার করেছি, আমি সেটির অর্থও ব্যাখ্যা করেছি। আমি এখন ভাবছি কেন আমরা সব প্রতিষ্ঠিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ জার্নাল থেকেও এই সব কারিগরী শব্দগুলোর অধিকাংশই নিষিদ্ধ করছি না। আমি ধরে নিয়েছি যে, সাধারণ পাঠকদের এই বিষয়ে বিশেষায়িত কোনো জ্ঞান থাকবে না। কিন্তু আমি তাকে নির্বোধ মনে করিনি। যে কেউই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে পারেন যদি সে বিষয়টিকে অতিমাত্রায় সরলীকরণ করতে পারেন। আমি কিছু সূক্ষ্ম আর জটিল ধারণাগুলো অগাণিতিক ভাষায় এর মূলসারটিকে না হারিয়ে জনপ্রিয় সহজপাঠ্য হিসাবে উপস্থাপন করতে কঠোর পরিশ্রম করেছি। জানিনা আমি সেটি করতে কতটুকু সফল হয়েছি বা কতদূর আমি সফল হয়েছি আমার আরো একটি লক্ষ্য পূরণে: বইটার বিষয়বস্তু যেমন দাবী করে, তেমন চিত্তাকর্ষক আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারার মত করে উপস্থাপন করতে। আমি বহুদিন ধরেই অনুভব করে আসছি জীববিজ্ঞানকে মনে হওয়া উচিৎ কোনো রহস্য কাহিনীর মতই উত্তেজনাপূর্ণ। কারণ রহস্য কাহিনী হচ্ছে ঠিক জীববিজ্ঞানের মতই। আমি অবশ্য এমন কোনো আশা করারও সাহস প্রকাশ করছি না যে, এই উত্তেজনার সামান্য অংশও যা এই বিষয়টি আমাদের নিবেদন করে তা প্রকাশ করতে পেরেছি।
আমার দ্বিতীয় কাল্পনিক পাঠক হচ্ছেন একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি হচ্ছেন কঠোর সমালোচক, আমার কোনো কথার কথা বা রুপক উদাহরণ তার শ্বাসপ্রশ্বাসকে চঞ্চল করে তুলবে। তার প্রিয় বাক্য হচ্ছে– উইথ দি এক্সেপশন অব’ বা ‘এটি ব্যতিরেকে’; ‘বাট অন দি আদার হ্যান্ড’ বা ‘কিন্তু আবার অন্য দিকে’ এবং বিতৃষ্ণায় উচ্চারিত ধ্বনি “উফফ। আমি মনোযোগের সাথে তার কথা শুনেছি, এবং এমনকি একটি অধ্যায় পুরোপুরি ভাবেই পুনরায় লিখেছি তার সুবিধার কথা বিবেচনা করে। কিন্তু পরিশেষে আমাকে এই কাহিনীটি বলতে হবে আমার মত করে। বিশেষজ্ঞ এখনো পুরোপুরি খুশী নন, যেভাবে আমি বিষয়গুলো সাজিয়েছি। তারপরও আমার সবচেয়ে বড় আশা যে এমনকি তিনিও এখানে নতুন কিছু খুঁজে পাবেন। পরিচিত ধারণাগুলো দেখার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো; হয়তো তার নিজের কিছু নতুন ধারণা সৃষ্টিতে এটি উদ্দীপনা যোগাবে। যদি এটি খুব বেশী বড় চাওয়া হয়ে যায়, তাহলে আমি কি নিদেনপক্ষে আশা করতে পারি যে, বইটি ট্রেনে পড়ার সময় তাকে আনন্দ যোগাবে?
তৃতীয় পাঠক, যে আমার মনে ছিল, তিনি হচ্ছেন শিক্ষার্থী, যিনি অবিশেষজ্ঞদের স্তর থেকে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার উত্তরণের কোনো পর্যায়ে আছেন। যদি এখনও তার মন স্থির না করে থাকেন তিনি কোন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হবেন, আমি তাকে উৎসাহিত করবো আমার নিজের ক্ষেত্র প্রাণিবিজ্ঞানের দিকে আরো আরেকবার দৃষ্টি দেবার জন্য। শুধুমাত্র এর সম্ভাব্য উপযোগিতা বিচার করা, কিংবা প্রাণীদের সাধারণত খুব সব সহজেই পছন্দ আদায় করে নেবার মত সহজাত ক্ষমতা ছাড়াও প্রাণিবিজ্ঞান পড়ার আরো উত্তম। কারণ আছে। এই কারণটি হচ্ছে আমরা প্রাণীরা হচ্ছি আমাদের জানা এই মহাবিশ্বে সবচেয়ে জটিল এবং নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত যন্ত্র। এভাবে যদি বলা হয় তাহলে কিন্তু বেশ কঠিন বোঝা কেনই বা কেউ অন্য কিছু পড়বে! ইতিমধ্যে যে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তারা প্রাণীবিজ্ঞান পড়বেন, আমি আশা করছি আমার বইটি তাদের জন্য কিছু শিক্ষণীয় বিষয় উপস্থাপন করার ভূমিকা পালন করবে। তবে তাকে এই বইটিকে তথ্যাভিজ্ঞ করা মূল সব প্রবন্ধ আর পাঠ্যপুস্তকগুলো পড়তে হবে, যার উপর নির্ভর করে এই বইটি আমি সাজিয়েছি। যদি মূল প্রবন্ধগুলো বুঝতে তার সমস্যা হয়, হয়তো আমার অগাণিতিক ব্যাখ্যা তাকে সেই ক্ষেত্রে সাহায্য করবে, ভূমিকা এবং বাড়তি সংযুক্তি হিসাবে। তিনজন ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের প্রতি আবেদন সৃষ্টি করার প্রচেষ্টায় স্পষ্টতই কিছু বিপদ আছে। আমি শুধু বলতে পারি যে এইসব বিপদগুলোর ব্যপারে খুব সচেতন ছিলাম কিন্তু প্রচেষ্টা করার সুবিধাগুলো সম্ভবত তাদের খানিকটা গুরুত্বহীন। করেছে।