যদিও ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্বটি সামাজিক আচরণ সংক্রান্ত গবেষণায় একান্ত জরুরী (বিশেষ করে যখন এটি সংযুক্ত হয় মেন্ডেলিয় জিনতত্ত্বের সাথে), তা সত্ত্বেও খুব বেশী ব্যাপকভাবে এটি অবহেলিত হয়ে এসেছে। সমাজ বিজ্ঞানের একটি পুরো শিল্প প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠেছে, সামাজিক এবং মনোজাগতিক পৃথিবীর প্রাক-ডারউইনীয় এবং প্রাক-মেন্ডেলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের প্রতি নিবেদিত হয়ে। এমনকি জীববিজ্ঞানের অভ্যন্তরেও ডারউইনীয় তত্ত্বের অবহেলা ও অপব্যবহার বিস্ময়কর। এই ধরনের একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভবের যে কারণই থাকুক না কেন, সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে এটি শেষ হতে চলেছে। ক্রমবর্ধিষ্ণু সংখ্যার জীববিজ্ঞানীরা ডারউইন এবং মেন্ডেলের অসাধারণ কাজগুলো সম্প্রসারিত করে চলেছেন, বিশেষ করে আর. এ. ফিশার, ডাবলিউ ডি, হ্যামিলটন, জি, সি, উইলিয়ামস এবং জে. মেনার্ড স্মিথ। এখন রিচার্ড ডকিন্স প্রথমবারের মত প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল সামাজিক তত্ত্বটির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সরল এবং সহজপাঠ্য হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।
সামাজিক তত্ত্বের এই সব নতুন গবেষণার মূল বিষয়গুলোকে ডকিন্স ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করেছেন: পরার্থবাদী এবং স্বার্থপর আচরণের ধারণাগুলো, আত্ম-স্বার্থের জিনতাত্ত্বিক সংজ্ঞা, আক্রমণাত্মক আচরণের বিবর্তন, কিনশিপ বা আত্মীয়তার তত্ত্ব (যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত পিতামাতা-সন্তান সম্পর্কগুলো এবং সামাজিক কীটপতঙ্গের বিবর্তন), লিঙ্গ অনুপাত তত্ত্ব, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা, প্রবঞ্চনা বা ছলনা এবং লিঙ্গ বৈষম্যগুলোর প্রাকৃতিক নির্বাচন। মূল ভিত্তি নির্মাণ করা তত্ত্বটি সম্বন্ধে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে, ডকিন্স তার এই নতুন কাজটিকে উন্মোচন করেছেন প্রশংসনীয় সুস্পষ্ট স্বচ্ছতা এবং শৈলীর মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত হয়েও তিনি এই বইয়ের পাঠকদের সমৃদ্ধ আর মনোমুগ্ধকর সাহিত্যের স্বাদ দিতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে যেখানে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেছেন (যেমন তিনি আমার নিজের একটি যৌক্তিক বিভ্রান্তির সমালোচনা করেছেন, তিনি সবসময়ই প্রায় সঠিক নিশানায় ছিলেন। ডকিন্স নিজেও যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন তার নিজের প্রস্তাবনার যৌক্তিক বিশ্লেষণটি সুস্পষ্ট করতে, যেন পাঠকরা, সেই প্রস্তাবিত যুক্তিগুলো প্রয়োগ করে তার যুক্তিগুলোকে আরো সম্প্রসারণ করতে পারেন (এমনকি ডকিন্সের বিরুদ্ধেও তার যুক্তিগুলো ব্যবহার করতে পারেন)। যুক্তিগুলো নিজেরাই সম্প্রসারিত বহু দিক বরাবর। যেমন, যদি ( যেমন, ডকিন্স যুক্তিটি ব্যবহার করেছেন) জীবদের পারস্পরিক যোগাযোগের মৌলিক বিষয়টি ‘ছলনা’ হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ছলনা শনাক্ত করার বৈশিষ্ট্যটি বিবর্তনের উপর শক্তিশালী নির্বাচনী চাপ থাকবে এবং এই কারণে এর উচিৎ হবে খানিকটা মাত্রার আত্ম-প্রবঞ্চনাকে নির্বাচন করা। যা কিছু বাস্তব তথ্য এবং উদ্দেশ্যকে অবচেতন করে দেয় যেন সেটি– আত্মজ্ঞানের সূক্ষ্ম সংকেত দ্বারা– ছলনার ব্যবহার বা চর্চা হওয়ার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনা। এভাবে, প্রথাগত সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই ধরনের স্নায়ুতন্ত্রকে বাছাই করে, চারপাশের পৃথিবী সম্বন্ধে যা আরো বেশী সুস্পষ্ট ধারণা দেবে, সেটি অবশ্যই মানসিক বিবর্তন সম্বন্ধে অতি সরলীকৃত একটি দৃষ্টিভঙ্গি।
সামাজিক তত্ত্ব সংক্রান্ত সাম্প্রতিক গবেষণার পরিমান এখন যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য, এটি প্রতি-বিল্পবী প্রতিক্রিয়ার একটি ছোট খাট কর্মতৎপরতার জন্ম দিয়েছে। যেমন, অভিযোগ আনা হয়েছে, সাম্প্রতিক এই অগ্রগতিগুলো, বাস্তবিকভাবে, সামাজিক প্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করতে চক্রাকারে চলমান একটি ষড়যন্ত্রেরই অংশ, এই ধরনের অগ্রগতিকে যা জিনগতভবে অসম্ভব বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। একই ধরনের দুর্বল চিন্তাগুলো একই সাথে গাথা হয়েছে এমন একটি ধারণা দেবার জন্য যে ডারউইনীয় সামাজিক তত্ত্ব এর রাজনৈতিক তাৎপর্যে প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু এই ধরণের কোনো অভিযোগ সত্য থেকে অনেক দূরে। ভিন্ন লিঙ্গের মধ্যে জিনগত সাম্যতা, প্রথমবারের মত, সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে ফিশার এবং হ্যামিলটনের গবেষণার মাধ্যমে। সামাজিক কীটপতঙ্গ গবেষণা থেকে সংগৃহীত তত্ত্ব এবং পরিমানবাচক উপাত্ত প্রদর্শন করছে যে তাদের সন্তানদের উপর প্রভাব বিস্তার করার পিতামাতাদের কোনো অন্তর্গত প্রবণতা নেই (এবং সন্তানদেরও সেই প্রবণতা নেই পিতামাতার প্রতি) এবং ‘প্যারেন্টাল’ বা পিতামাতার বিনিয়োগের ধারণা এবং স্ত্রী সদস্যদের চয়েস বা বাছাই একটি নৈর্ব্যক্তিক আর পক্ষপাতহীন ভিত্তি প্রদান করেছে লিঙ্গ বৈষম্যগুলো দেখার জন্য, বৃত্তিহীন জৈববৈজ্ঞানিক পরিচয়ের জলায় নিমগ্ন নারীর ক্ষমতা আর অধিকার সমর্থনের জনপ্রিয় আন্দোলনের চেয়ে যা একটি উল্লেখযোগ্য পরিমান অগ্রগতি। সংক্ষেপে ডারউইনীয় সামাজিক তত্ত্ব আমাদেরকে সামাজিক সম্পর্কগুলোর একটি অন্তর্নিহিত সাম্যতা ও যুক্তির আভাস দেয়; যখন আমরা আরো পুরোপুরিভাবে বুঝতে সক্ষম হব, সেটি অবশ্যই আমাদের আমার রাজনৈতিক বোধকেও নবায়ন করবে এবং মনোবিজ্ঞানের চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের প্রতি বৌদ্ধিক সমর্থন প্রদান করবে। এই পক্রিয়ায় এটি আমাদের দুঃখকষ্টের মূল কারণগুলো সম্বন্ধে গভীর উপলদ্ধিও প্রদান করবে।