জানাদু হোটেলে থেকে এই ব্যর্থতার পর তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল সেই শিশুকাল। অথচ সবসময় ক্লডিয়া তা ভুলে থাকতে চায়। কুওগে ক্লডিয়া কখনোই তার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করত না। ক্লেরিকুজিও পরিবারের সাথে কোনোরকম স্বেচ্ছাসেবী কর্মকর্মেও সে নিজেকে জড়াতে চায় না। এমনকি কুওগে তার ছেলেবেলার স্মৃতিটুকুও মুছে ফেলতে চায়। কখনোই মনে করতে চায় না তার বাবার কথা অথবা কোনো ক্লেরিকুজিও’র কথা।
০৩. রিকুজিও অ্যান্ড পিপি ডি লিনা
পর্ব–২
দ্য ক্লেরিকুজিও অ্যান্ড পিপি ডি লিনা
০৩.
ক্লেরিকুজিও ফ্যামিলির দুর্দান্ত উত্থান ঘটে সিসিলিতে। এ উত্থানের ইতিধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে শত বর্ষেরও বেশি সময়। আর এই দীর্ঘ সময়ে প্রথমার্ধের প্রায় কুড়িটি বছর কেটেছে কেবল যুদ্ধে আর যুদ্ধে। একটি বনের সামান্য একটি অংশের অধিকার নিতে ক্লেরিকুজিও হারিয়েছে তার অসংখ্য লোক। তেমনি অপর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষও খুইয়েছে তাদের আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।
ক্লেরিকুজিও উত্থানের পরবর্তী সময়ের ঘটনা। প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন ডন পিয়েত্রো ফোরলেঞ্জার। ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীর সাথে দীর্ঘ বিবাদ ফ্যাসাদের মধ্য দিয়ে ফোরলেঞ্জার পঁচাশিটি বছর অতিবাহিত হয়। এ বয়সে এসে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সময় তার শেষ হয়ে এসেছিল। চিকিৎসকও তার জীবনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন বড়জোর এক সপ্তাহ বাঁচবেন তিনি। এক সময়ের প্রচণ্ড দাপটে ফোরলেঞ্জার শেষ দিনগুলো কাটবে কেবল বিছানায় শুয়ে থেকে তাও আবার চিকিৎসকের বেঁধে দেয়া সময়ের প্রহর গুনতে গুনতে। অসহায়ের মতো শুধু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া কিই বা করার আছে তার?
কিন্তু এক সপ্তাহ অর্থাৎ সাতটি দিনও যেন অনেক বেশি মনে হলো প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লেরিকুজিও’র লোকজনের। ফোরলেঞ্জার অসহায়ত্বের সুযোগ নিল তারা। আকস্মিক ক্লেরিকুজি ওর লোক তার শয্যাকক্ষে প্রবেশ করে ফোরলেঞ্জাকে আতঙ্কিত করে তুলল। তারপর আঘাতের পর আঘাত করে নির্মম মৃত্যু উপহার দিল। এ সময় অসহায় অবস্থা পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধ ফোরলেঞ্জা আত্মরক্ষায় কেবল যন্ত্রণাকাতর চিৎকারই দিতে পেরেছিলেন এর বেশি কিছু নয়। তারপর চিরদিনের জন্য বিদায়।
ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও প্রায়ই এই পুরনো গল্পের অবতারণা করতেন। এই হত্যাকাণ্ডকে তিনিও মন থেকে সায় দিতে পারেননি কোনো দিন। তিনি বলতেন, সেকালের হত্যাকাণ্ডের ধরন ছিল অত্যন্ত নির্মম ও বোকার মতো। একথা বলে তিন মূলত বোঝাতে চাইতেন– অসহায়ের ওপর আক্রমণ বা হিংস্রতা সম্পূর্ণরূপে বৃথা-দম্ভ মূল্যহীন বীরত্বের অহং। অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া কোনো আক্রমণেরই মূল্য নেই- এটা সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
ডন ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও আসলে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তৎকালীন ক্লেরিকুজিওদের এমন বৃথা দম্ভের নীতিই তাদের পতন ঘটিয়েছিল।
ইতালিতে মুসোলিনি ও তার ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় আসার পর তারা বুঝতে পেরেছিলেন সর্বপ্রথম মাফিয়াদেরই ধ্বংস করতে হবে। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে তারা কিছু আইনের পরিবর্তন করেন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী নামিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে মাফিয়াদের মেরুদণ্ড নড়বড়ে হয়ে যায়। শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর তুমুল অভিযানে হাজার-হাজার নিরপরাধ মানুষকেও মূল্য দিতে হয়। অনেকেই কারাবরণ করে, আবার মাফিয়াদের সাথে নির্বাসনে যেতে হয় অনেককে, অনেকের মৃত্যুও হয়।
মুসোলিনির কৌশলে ইতালির মাফিয়া সংগঠনগুলোর বিনাশ ঘটলেও একমাত্র ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীটি ফ্যাসিবাদী আইন ও এর সেনা মোতায়েনের বিষয়টিকে মেনে নিতে পারেনি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারা শুরু করে প্রচণ্ড বিদ্রোহ। স্থানীয় ফ্যাসিস্ট নেতাদের একে একে হত্যা করতে থাকে, ফ্যাসিস্ট গ্যারিসনে হামলা চালায়। ক্লেরিকুজিওদের এমন তৎপরতাকে আরো প্রবল করে মুসোলিনি। পালামোতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা তার বোলার হ্যাট ও ছাতা চুরি করে নিয়েছে এই দস্যুরা।
মাফিয়াদের দমন করতে এটি ছিল সে সময় মুসোলিনির অত্যন্ত ফলপ্রসূ রটনা ও একই সাথে অবমাননাকর উক্তি। অবশ্য এর জন্য মুসোলিনি বেশ হাস্যাস্পদ হয়েছিলেন সিসিলিতে, তবে তাদের ধ্বংসের সূত্রপাতও হয়েছিল এ থেকে। এর পরপরই সিসিলি প্রদেশে সশস্ত্র বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এ অভিযান ঠেকাতে ক্লেরিকুজিও গোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক সদস্যের মৃত্যু ঘটে। আরো প্রায় পাঁচশ সদস্য ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী একটি অনুর্বর অঞ্চলে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে সে অঞ্চলকে দণ্ডিত অরাধীদের উপনিবেশ পেনাল কলোনি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
সেই অভিযানে প্রচণ্ড ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও বেঁচে যান শক্ত প্রাণের ক্লেরিকুজিও। তার পরিবারের কয়েক সদস্যও একই সাথে রক্ষা পায়। ক্লেরিকুজিও, তার সন্তান ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য আমেরিকায় নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
কিন্তু যে মাফিয়া ডন ক্লেরিকুজিও’র রক্ত ডোমেনিকোর শরীরে সে কি এত সহজে ছাড়তে পারে পরম্পরা? ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও’র রক্তও পূর্বপুরুষের ধারাতেই আত্মপ্রকাশ করল। আমেরিকায় সে গড়ল তার আপন সাম্রাজ্য। পূর্বপুরুষর ঘটনা, ইতিহাস ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতায় ডোমেনিকো ক্লেরিকুজিও হলেন আরো ধূর্ত, আরো কৌশলী ও শক্তিশালী। তবে তিনি মনে করতেন, আইন-শৃঙ্খলাহীন রাষ্ট্র সব সময়ই শক্রস্বরূপ, আর এদিক থেকে আমেরিকা তার পছন্দের। তিনি আমেরিকা ভালোবাসেন।