- বইয়ের নামঃ অশুভ ছায়া
- লেখকের নামঃ অনীশ দাস অপু
- সিরিজঃ সেবা হরর সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প
অশুভ ছায়া
অশুভ ছায়া
অ্যানুবিসের বিশাল মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। ওর অন্ধ চোখ শত সহস্র বছরের অসীম আঁধার সয়ে আসছে, হাজার বছরের ধুলো জমেছে পাথুরে ভ্রুতে। গুহার স্যাঁতসেঁতে হাওয়া বিকট মূর্তির গায়ে সৃষ্টি করেছে কালের ক্ষত, তবে পাথরের ঠোঁট দুটোর পৈশাচিক হাসির ভয়াবহতাকে ম্লান করতে পারেনি একটুও। যেন জ্যান্ত দানব একটা। কিন্তু শেয়াল দেবতা অ্যানুবিস নিষ্প্রাণ একটা পাথুরে মূর্তি ছাড়া কিছুই নয়। এই দেবতার যারা পূজা করত সেই পূজারীরা মরে কবে ভূত হয়ে গেছে। এই গুহার চারপাশে যেন মৃত্যুর ছায়া, এই ছায়া যেন ঘুরে বেড়ায় অ্যানুবিসকে ঘিরে। ঘাপটি মেরে আছে মমির কফিনে, গা মিশিয়ে আছে শতাব্দী প্রাচীন মেঝের ধুলোর স্তূপে। মৃত্যু এবং অন্ধকারের এই ভয়াল রাজ্যে আলোর প্রবেশ নিষেধ। গত তিন হাজার বছরে এখানে আলোর একটি রেখাও দেখা যায়নি। কিন্তু তিন হাজার বছর পর আজ দেখা গেল। গুহাগুলোর শেষ মাথায় ঝনঝন শব্দ শোনা গেল, কারা যেন ত্রিশ শতকের পুরোনো লোহার গেট খুলে ফেলল। তারপর খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রতিফলিত হলো মশালের আলো, এরপর ভেসে এল মানুষের গলা। ব্যাপারটা রোমহর্ষক এবং অদ্ভুত। গত তিন হাজার বছরে এই কালো এবং ঘুটঘুটে অন্ধকার সমাধিস্তম্ভে আলোকরেখার কোনও প্রবেশ ঘটেনি। গত তিন হাজার বছরে ধুলোয় ধূসরিত মেঝেতে পড়েনি কারও পায়ের ছাপ। গত তিন হাজার বছরে এই গুহার প্রাচীন বাতাস বয়ে আনেনি কোনও মনুষ্য কণ্ঠ। এই গুহায় শেষ আলোকরেখা বিচ্ছুরিত হয়েছিল বাস্ত্-এর সন্ন্যাসীর হাতের মশাল থেকে; ধুলোয় শেষ পায়ের ছাপ পড়েছিল মিসরীয়দের; শেষ কণ্ঠটি শোনা গিয়েছিল নীলনদের এক পূজারীর। কিন্তু আজ, হঠাৎই গুহামুখ আলোকিত হয়ে উঠেছে বৈদ্যুতিক মশালের আলোয়, মেঝেয় বুট জুতোর শব্দ আর বাতাসে পুরুষালি ইংরেজ কণ্ঠ।
মশালের আলোয় মশালবাহীর চেহারা দেখা গেল। মানুষটি লম্বা, রোগা। বাঁ হাতে ধরা পার্চমেন্ট কাগজের মতই তাঁর চেহারায় বয়সের রেখা সুস্পষ্ট। ভদ্রলোকের মাথার চুল যেন কাশফুল, কোটরাগত চোখ আর হলদেটে ত্বক তাঁকে বুড়ো মানুষের কাতারে ফেললেও ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসিতে মালিন্য নেই একবিন্দু, যুবকের আত্মপ্রত্যয় এবং দৃঢ়সংকল্প যেন ধারণ করে আছে ওই হাসি। তাঁর ঠিক পেছনেই এক তরুণ, হুবহু বৃদ্ধের চেহারা। বোঝাই যায় যুবক বৃদ্ধের সন্তান।
‘আমরা তা হলে ঠিক জায়গায় এসে পড়েছি!’ উত্তেজিত হয়ে বলল তরুণ।
‘হ্যাঁ, খোকা, এসেছি।’ হাসিমুখে জবাব দিলেন বাবা।
‘বাবা, দেখ! ওই যে সেই পাথরের মূর্তি। ম্যাপে যেটার নাম লেখা ছিল!’
মেঝেতে হালকা পায়ে দুজনে আগে বাড়লেন, মূর্তিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সার রোনাল্ড বার্টন হাতের মশালটা উঁচিয়ে ধরলেন শেয়াল দেবতাকে ভাল করে দেখার জন্য। পিটার বার্টন তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে চাইল কদাকার চেহারাটার দিকে।
অনেকক্ষণ ধরে দুজনে খুঁটিয়ে দেখলেন বিশাল মূর্তিটিকে। দরজা দিয়ে আসা দমকা হাওয়া অ্যানুবিসের গা থেকে অনেকটা ধুলো উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। মশালের আলোয় চকচক করছে ওটার গা। বারো ফুট লম্বা, মানুষ আকৃতির কুকুরমুখো ওই শেয়াল দেবতার গোটা অস্তিত্বে অশুভ এবং ভয়ঙ্কর কী যেন একটা আছে। মূর্তিটার লম্বা হাত দুটো অভিশাপ দেয়ার ভঙ্গিতে উঁচিয়ে আছে, যেন কেউ তার শান্তিভঙ্গ করতে এলে লাফ দিয়ে বহিরাগতকে ধ্বংস করে ফেলবে। দানব মূর্তির পেছনে উঁকি দিলেন সার রোনাল্ড বার্টন। খালি একটা কুলুঙ্গি ছাড়া কিছু নেই ওখানে।
মূর্তির হাসিটা দারুণ জীবন্ত মনে হলো, পাথুরে চোখ দুটো যেন সতর্ক করে দিচ্ছে, সাবধান। কাছে এসো না।
দুজনের কেউ কথা বলছেন না, তবে দু’জনেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, গুমট, দমবন্ধ করা অবস্থা, আলো-ছায়ার এই গুহায় কীসের যেন অশুভ সঙ্কেত, বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত নীরবতা ভাঙলেন সার বার্টন নিজেই। ‘ঠিক আছে, খোকা। সারাদিন এটার দিকে তাকিয়ে থাকলে কোনও ফায়দা হবে না। আমাদের এখন অনেক কাজ বাকি। ম্যাপটা একবার দেখে নিয়েছিস তো?’
‘দেখেছি, বাবা,’ মৃদু গলায় জবাব দিল ছেলে। বাপের মত গমগমে কণ্ঠ নয়। এখানকার বাতাসে দম নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। কেমন নর্দমার গ্যাসের গন্ধ। তবে পুঁতি গন্ধটাকে সে সহ্য করে থাকল। কারণ পিটার জানে সে তার বাবার সঙ্গে একটি গোপন সমাধিস্তম্ভে প্রবেশ করেছে, মাটি থেকে সাতাশ ফুট নীচে। ত্রিশ শতাব্দীর প্রাচীন এক সমাধিস্তম্ভে। সমাধি আবিষ্কারের আনন্দও কিছুতেই মাথা থেকে অভিশাপের কথাটা বিস্মৃত হতে দিতে চাইছে না।
এই জায়গার ওপর একটি অভিশাপ রয়েছে; আর সেটি জানার জন্যই মূলত এখানে আসা। সার রোনাল্ড প্যাপিরাস পার্চমেন্ট ম্যাপটির সন্ধান পেয়েছেন নিনথ পিরামিড খুঁড়তে গিয়ে। কী করে তিনি অভিযানকারী দলের অন্যান্যদের ফাঁকি দিয়ে কাগজখানা হাতড়িয়েছেন কেউ জানে না। কিন্তু যে ভাবেই হোক কাজটা করেছেন তিনি।
অবশ্য মানচিত্র চুরি করার জন্য তাঁকে খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। কারণ গত বিশ বছরে সার রোনাল্ড বার্টন অসংখ্য মরুভূমি চুল আঁচড়ানোর মত আঁচড়েছেন, আবিষ্কার করেছেন বহু পবিত্র ধ্বংসাবশেষ, মর্মোদ্ধার করেছেন কঠিন এবং দুর্বোধ্য সব চিত্রলিপির, কবর খুঁড়ে তুলেছেন কত মমি, স্ট্যাচু, প্রাচীন আসবাবপত্র, মূল্যবান পাথর। কিন্তু তাতে কী লাভটাই বা হয়েছে? যে সরকারের জন্য, দেশের জন্য, পুরাতত্ত্বের সমৃদ্ধির জন্য এত পরিশ্রম করেছেন তিনি, রক্ত পানি হয়ে গেছে খাটতে খাটতে, সেই দেশ কিংবা সরকার তো তাঁকে কিছু দেয়নি। অন্তত পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধানের আসনে অধিষ্ঠিত করার সম্মানটুকু পর্যন্ত দেখায়নি। তা হলে, শেষ বয়সে খ্যাতি এবং অর্থপ্রাপ্তির আশায় তিনি যদি একটু এদিক-সেদিক করেনই, তা হলে কি তাঁর খুব বেশি নিন্দা করা যায়?