মেনকো একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অতি কষ্টে সেটা তুলে ইশারা করল। সবাই বুঝল ঈশারাটা। ডনের ছেলেরা, গেনকোর স্ত্রী এবং মেয়েরা নিঃশব্দে সরে গেল। সরু হাতটা দিয়ে ডন কর্লিয়নিকে আঁকড়ে ধরে কথা বলতে চেষ্টা করছে গেনকো। খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসলেন ডন। ওদের ছেলেবেলার কথা যা মনে আসছে, বক বক করে যাচ্ছে গেনকো আবানদাণ্ডো। তার কালো নিষ্প্রভ চোখ দুটোয় চাতুর্য চিকচিক করে উল। অস্ফুটে কি বলল, শোনা গেল না, আরেকটু নিচু হলেন ডন। একটু দূরে কেবিনে আর যারা রয়েছে তারা এই করুণ দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত। মাথা নাড়ছেন ডন কর্লিয়নি। তাঁর গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে চোখের পানি।
কাঁপা গলায় আরও জোর পেল গেনকো। সবাই শুনতে পাচ্ছে এখন তার কথা। প্রাণপণ চেষ্টা করে, হাঁপাতে হাঁপাতে বালিশ থেকে মাথাটাকে তুলে ফেলল সে। রোগা হাতের একটা কাঠির মত আঙুল ডনের দিকে খাড়া করল, বলল, গড ফাদার, তোমার দুটো পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে মরে যেতে দিয়ো না। গড় ফাদার, হাড়ে আমার দাউ দাউ আগুন জ্বলছে, পোকায় মগজ খাচ্ছে–এর যে কি কষ্ট সব আমি টের পাচ্ছি। গড ফাদার, ও গড ফাদার, তোমার কতটুকু ক্ষমতা সে আমি জানি। তুমি পারো! গড ফাদার, তুমি আমাকে ইচ্ছে করলেই ভাল করে দিতে পারো! মনে, নেই, ছোটবেলায় কর্লিয়নিতে আমরা একসাথে খেলেছি, একসাথে বড় হয়েছি? আমাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, এ সম্পর্ক কোন কালে নষ্ট হবার নয়তবু তুমি আমাকে মরে যেতে দেবে? না, গড ফাদার, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। পাপ করেছি, কিন্তু তোমার সাথে যতক্ষণ আছি কাউকে ডরাই না। নরক আমার কাছে ভীষণ ভীতিকর। তুমি যেভাবে হোক আমাকে বাঁচিয়ে দাও, গড় ফাদার, আমি মরতে চাই না।
শান্ত কিন্তু গম্ভীর গলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে শুরু করলেন ডন কর্লিয়নি। অবিশ্বাসীর ভুল ভেঙে দেবার জন্যে তিনি চাইছেন তার প্রক্রিট শব্দ যেন গেনকো এবানদাণ্ডের কান হয়ে মগজে পৌঁছায়। ভাই গেনকো, সে ক্ষমতা যদি আমার থাকত, বিশ্বাস করো, সৃষ্টিকর্তার চেয়েও বেশি দয়া দেখাতাম তোমাকে। না, ভাই, নরকের কথা ভেবে তুমি নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। কথা দিচ্ছি, প্রতিদিন দুবেলা উপাসনার আয়োজন করব আমি, যাতে তোমার আত্মা, শান্তি পায়। তোমার পরিবারের সবাই তোমার আত্মার কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করবে। আমরা সবাই এতগুলো মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে ধরনা দেব, তারপরও তিনি তোমাকে সাজা দেবেন এ হতে পারে না।
কঙ্কালের মুখে বিশ্রী একটা ধূর্ত ভাব ফুটে উঠল। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে তাহলে?
কঠিন সান্ত্বনাহীন শোনাল ডনের উত্তরটা, অবিশ্বাসীর মত প্রলাপ বোকো না। মেনে নাও, আত্মসমর্পণ করো।
ঝপ করে পড়ে গেল বালিশের উপর মাথাটা। দপ্ করে নিভে গেল চোখ থেকে উন্মত্ত আশার আলোটা। কেবিনে ব্যস্তভাবে ঢুকল নার্স, সবাইকে জোরজার করে কেবিন থেকে বের করে দিচ্ছে সে? ডনও উঠে দাঁড়ালেন।
তার দিকে হাত বাড়িয়ে অসহায় গেনকো আবানদাণ্ডো করুণ আবেদনের সুরে বলল, গড ফাদার, আমাকে ফেলে চলে যেয়ো না। কাছে থেকে তুমি আমাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে অন্তত সাহায্য করো। তোমাকে দেখে হয়তো ভয় পেয়ে যাবে সে, আমার শান্তি ভঙ্গ করতে সাহস পাবে না। বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে যেভাবে হোক একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারো হয়তো, কি বলো? বিবর্ণ ঠোটু বাকা করে কথা বলছে গেনকো আবানদাণ্ডো, উনকে এখন যেন সে বিদ্রূপ করছে। হাজার হোক তোমাদের রক্তের সম্পর্ক, সেটা তো আর তুমি অৰীকার করতে পারো না? ডন রাগ করবেন ভেবে এবার ভয় হলো তার, তাড়াতাড়ি তার হাতটা ধরে ফেলল। আমি তোমার হাতটা ধরে আছি, তুমি আমার কাছে থাকো। দুজন একসাথে অমন কত লোককে আমরা নতি স্বীকার করিয়েছি, আর এ ব্যাটাকে জব্দ করতে পারব না? থাকো, গড ফাদার, ভয় লাগছে, দয়া করে আমার কাছে থাকো।
ইশারা করে সবাইকে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন ডন কর্লিয়নি। শুকিয়ে ছোট হয়ে যাওয়া গেনকো আবানদাণ্ডোর হাতটা নিজের দুই মস্ত হাতে তুলে নিলেন। মৃত্যু আসবে, তারই অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধুর পাশে। কোমল স্বরে কত রকমের আশ্বাস দিচ্ছেন বন্ধুকে ডন।
.
.
আজকের দিনটা কনি কর্লিয়নির ভাল ভাবেই কাটল। স্বামী হিসেবে বিয়ের প্রথম রাতের কর্তব্য অত্যন্ত দক্ষতা এবং বলিষ্ঠতার সাথে পালন করল কার্লো রিটসি। উপহার হিসেবে পাওয়া টাকার কথা সারাক্ষণ মনে থাকায় কর্তব্য পালনে সাংঘাতিক উৎসাহ দেখিয়েছে সে। কুড়ি হাজার ডলার, কম নয়। কনি অবশ্য যে ব্যগ্রতার সাথে। তার কুমারীত্ব বর্জন করল, টাকাগুলো হাতছাড়া করার সময় সেরকম ব্যগ্র তাকে হতে দেখা গেল না। কালো কিন্তু ভারি চালাক, সারারাত স্ত্রীকে জাগিয়ে রেখে তার এমন যত্ন নিল যে কনির চোখে কালসিটে পড়ে গেল।
ওদিকে সনি কর্লিয়নি কখন টেলিফোন করবে এই আশায় বাড়িতে বসে ছটফট করছে লুসি ম্যানচিনি। তার বিশ্বাস সনি আবার যোগাযোগ না করেই পারে না। শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে সে-ই ফোন করল অপর প্রান্তে এক মহিলার গলা শুনে সাথে সাথে রিসিভাব ক্রাডলে নামিয়ে রাখল সে। তার জানার কথা নয় যে তাকে নিয়ে সনি আধঘণ্টার জন্যে আড়ালে গিয়ে কি করেছে তা নিয়ে কানাকানি হয়েছে বিয়ে বাড়ির চারদিকে, সবাই বলাবলি করেছে:আরেকটা শিকার বালিয়েছে সান কর্লিয়নি।