নিউটনের এই বই-এর ভিত্তি উচ্চশ্রেণীর জ্যামিতি হলেও এর মধ্যে যেমন রয়েছে গভীর দর্শন তেমনি জটিল গণিত ও অসাধারণ সব বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। বইটির সংক্ষিপ্ত নাম প্রিন্সিপিয়া। ইংরাজি প্রিনসিপল শব্দের ল্যাটিন উচ্চারণ হল প্রিন্সিপিয়া।
পরপর তিনটি বইয়ের সংকলন হল প্রিন্সিপিয়া। প্রথম বইটির আলোচ্য বিষয় গতিসূত্র। এতে রয়েছে পরপর তিনটি সূত্র।
প্রথম সূত্র হল : Every body continues in its state or rest or of uniform motion in a straight line unless it is compelled by external force to change that state of inertia
দ্বিতীয় সূত্র হল : Rate of Change of momentum is proportional to the force acting, and the Change takes place in the direction in which the force acts
তৃতীয় সূত্র : To every action there is an equal and oppoite reaction।
প্রিন্সিপিয়ার দ্বিতীয় বইতে নিউটন আলোচনা করেছেন প্রতিরোধী বস্তুর মাধ্যমের ভিতরে যে কোন বস্তুর গতি নিয়ে।
প্রতিরোধী বস্তু হিসেবে তিনি তরল ও বায়বীয় এই দুই পদার্থকেই গ্রহণ করেছেন।
নিউটনের মতে যে কোন গ্যাসই অসংখ্য স্থিতিস্থাপক পরমাণুর মিশ্রণ। গ্যাসের ওপর চাপই তার আয়তন নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রিন্সিপিয়ার তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে সৌরজগৎ ও প্রকৃতির অভিকর্ষ বলের কথা। তিনি পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কিভাবে পৃথিবীর বুকে পতনশীল বস্তুর ওপর অভিকর্ষ বল কাজ করে এবং এই একই বলের প্রভাবে মহাকাশের গ্রহতারা তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে থেকে নির্দিষ্ট নিয়মে কাজ করে।
এই অভিকর্ষ বলের টানেই যে সমুদ্রে জোয়ার ভাটা খেলা করে সেই কখাও তিনি বলেছেন।
নিউটনের বক্তব্যের অর্থ হল, সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর পিছনেই রয়েছে নির্দিষ্ট যুক্তি ও অবিসংবাদি কারণ।
প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের পর এবারে নিউটন পেলেন অকুণ্ঠ প্রশংসা, সাধুবাদ আর অপ্রতিহত খ্যাতি।
খ্যাতির সঙ্গে এল প্রাপ্তি। ১৮৮৯ খ্রি: ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্ট নিউটনকে সদস্য পদে বরণ করল। কেমব্রিজের বিজ্ঞান বিভাগ পরিচালনার সময় দায়িত্বও তিনি পেলেন।
১৭০১ খ্রি: পেলেন দেশের সমস্ত টাকশালের অধ্যক্ষপদ। অবশ্য এই পদ পাবার পর তিনি পার্লামেন্ট থেকে অবসর নেন। ১৭০৩ খ্রি: তিনি রয়াল সোসাইটির সভাপতি পদে বৃত হলেন। আমৃত্যু ১৭২৭ খ্রি: তিনি এই পদ অলঙ্কৃত করেছেন।
১৭০৫ খ্রি: মহারানী অ্যান নিউটনকে নাইট উপাধিতে সম্মানিত করলেন। তাঁর নামের আগে যুক্ত হল স্যার। এই বিরল সম্মান বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই প্রথম লাভ করেন।
পদ বা পদক যাই জুটুক না কেন নিজ প্রতিভাগুণেই নিউটন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন বলে স্বীকৃত হয়েছেন। তাঁর আবিষ্কারের সূত্র ধরেই আধুনিক বিজ্ঞানধারণা সুদূরপ্রসারী ফল ফলিয়ে চলেছে।
১১. ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি:)
যিনি কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে ছিলেন সারাটা জীবন, এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ধন-সম্পদ, ভোগ বিলাস ও প্রাচুর্যের মোহ যাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, যিনি ছিলেন মুসলমানদের গৌরব তিনি হলেন ইবনে সিনা। তাঁর আসল নাম আবু আলী আল্ হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি সাধারণত ইবনে সিনা, বু–আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামেই অধিক পরিচিত। ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তুর্কীস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রাম তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা বিবি। পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন খোরাসানের শাসনকর্তা। জন্মের কিছু কাল পরই তিনি ইবনে সিনাকে রোখারায় নিয়ে আসেন এবং তার লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করেন। ছোট বেলা থেকেই তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে, ফেলেন। তাঁর ৩ জন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ইসমাইল সুফী তাঁকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ শাস্ত্র ও তাফসীর; মাহমুদ মসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিত শাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল্ না’তেলী শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আন্ত মাজেস্ট, জওয়াহেরে মান্তেক প্রভৃতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সকল জ্ঞান তিনি লাভ করে ফেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক আল না’তেলীর নিকট এমন কোন জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিল না, যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারবেন। এরপর তিনি ইবনে সিনাকে নিজের স্বাধীন মত গবেষণা দেন।
এবার তিনি চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত কিতাব সগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন। ইবনে সিনা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, এমন বহু দিবারাত্রি অতিবাহিত হয়েছে যার মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যেও ঘুমাননি। কেবলমাত্র জ্ঞান সাধনার মধ্যেই ছিল তার মনোনিবেশ। যদি কখনো কোন বিষয় তিনি বুঝতে না পারতেন কিংবা জটিল কোন বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই তিনি মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন এবং সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন, “হে আল্লাহ তুমি আমার জ্ঞানের দরজাকে খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার ও কামনা নেই।” তারপর গৃহে এসে আবার গবেষণা শুরু করত। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তার মনের মধ্যে ভাসততা এবং তার জ্ঞানের দরজা যেন খুলে যেত। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করে বাদশাহকে সুস্থ করে তোলেন। বাদশাহ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার জন্যে রাজ দরবারের কুতুবখানা উন্মুক্ত করে দেন। মাত্র অল্প কয়েকদিনে তিনি অসীম ধৈর্য ও একাগ্রতার সাথে কুতুবখানার সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোন বিষয় বাকি ছিল না যা তিনি জানেন না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদতত্ত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্র, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল মজমুয়া’ নামক একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন, যার মধ্যে গণিত শাস্ত্র ব্যতীত প্রায় সকল বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।