নিউটন তার আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণ সূত্র ও অভিকর্ষ বলের কথা বাইরে প্রকাশ করবার আগেই বুঝতে পারলেন, এই মহাসত্য ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পদার্থ বিজ্ঞান ও সৌরবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব উপস্থিত হবে, নিয়ে আসবে নতুন যুগ।
আবিষ্কৃত সত্যকে দৃঢ় মূল ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য পুনঃ পুনঃ বিশ্লেষণ ও পরীক্ষার দরকার। তাই নিয়েই মেতে উঠলেন তিনি।
১৬৬৫-৬৬ খ্রি: মধ্য নিউটন আবিষ্কার করলেন আলোর প্রতিসরণ সূত্র বা Law of Refraction of light।
তিনি দেখলেন, এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে ঢুকবার সময় আলো যে বাঁক নেয়, তার পরিমাণ নির্ভর করে মাধ্যমের ঘনত্বের ওপর।
ইতিপূর্বে তেলা কাঁচ মাধ্যম বা প্রিজম আর লেনস–এই দুই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কাঁচের সাহায্যে দৃষ্টি বিবর্ধক চশমা তৈরি সম্ভব হয়েছে, সম্ভব য়েছে দূরবীন তৈরি।
লিউয়েন হক তৈরি করেছিলেন জীবজগতের সূক্ষ্মতম অধিবাসীদের দেখবার উপযোগী অণুবীক্ষণযন্ত্র।
নিউটন প্রিজন ও লেনস নিয়ে নাড়াচাড়া করে দূরবীনের একটি মারাত্মক ক্রটি আবিষ্কার করে ফেললেন।
দূরবীনের লেনসে সৌরজগতের যে ছবি ভেসে উঠত, তাতে থাকত নানা বর্ণের রেখার বর্ণবৃত্ত। এর ফলে গ্রহনক্ষত্রের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ে কাজ বড় রকমের বাধার সম্মুখীন হত। এই বর্ণঘটিত বিভ্রাটকে বলা হয় CHROMATIC ABERRATION বা বর্ণঘটিত স্থানচ্যুতি।
আলোক বিজ্ঞানীরা দূরবীনের এই ত্রুটি সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু তারা মনে করতেন দূরবীনের এই ক্রটি প্রকৃতিগত অর্থাৎ ন্যাচারাল ফ্লো–এই ত্রুটিমুক্ত দূরবীন তৈরি অসম্ভব।
নিউটন এই বর্ণবিভ্রাট মুক্ত দূরবীন তৈরি করলেন। এর সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রদের প্রকৃত দূরত্ব নির্ণয় করতে গিয়ে বর্ণঘটিত স্থান চ্যুতির বিঘ্ন থাকল অতি সামান্য মাত্রায়।
পরে ১৭৬০ খ্রি: তাঁর অনুসরণেই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত দূরবীন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন আলোকবিজ্ঞানী জন ডোনাল্ড।
আলো ও বর্ণঘটিত নানা তত্ত্বও তথ্য যখন প্রকাশ করেন তখন নিউটনের বয়স ত্রিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই।
তার এই গবেষণা প্রবন্ধ ইউরোপের বিজ্ঞানীমহলে প্রবল বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। লন্ডনের বিখ্যাত রয়াল সোসাইটি তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি জানালেন তাকে সংস্থার সদস্য পদে নির্বাচিত করে।
এই সম্মান প্রাপ্তির পর নিউটন কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ নিজের বর্ণঘটিত ত্রুটিমুক্ত দূরবীনটি রয়াল সোসাইটিতে উপহার পাঠিয়ে দেন।
১৬৬৭ খ্রি: নিউটনকে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে অঙ্কের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি এই মহাবিদ্যালয়ের কাজে ছিলেন। এই সময়ে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যা নিয়ে একের পর এক গবেষণা করেছেন তিনি। রসায়ন নিয়েও কিছুকাল কাজ করেছেন।
ক্ষারীয় বা ক্ষারধর্মী ধাতুকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সোনায় পরিণত করা যায় কিনা তা নিয়েও পরীক্ষা করেছেন।
নিরন্তর গবেষণার মধ্যে থেকে বয়স তিরিশ হতে না হতেই সমস্ত চুল ধবধবে সাদা হয়ে গেল তার।
যে কোন বিষয়ে একনিষ্ঠ মনঃসংযোগের বিরল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। যে কোন বিষয় একবার মাথায় ঢুকলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারতেন না। তাঁর সবচেয়ে মহৎ গুণ যেটি ছিল তা হল অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ এড়িয়ে মূল লক্ষে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা। তাঁর প্রতিটি গবেষণার কাজ এগিয়েছে নির্দিষ্ট নিয়মের পথ ধরে। প্রথমে বিষয় নির্বাচন, পরে মূলনীতি নির্ধারণ। সবশেষে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলা।
১৬৮৪ খ্রি: এক তরুণ সৌরবিজ্ঞানী কেমব্রিজে এসে নিউটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। এই বিজ্ঞানীর নাম এডমুন্ড হ্যানি। তাঁর নামেই পরে একটি বিশেষ ধূমকেতুর নাম হ্যানির ধূমকেতু রাখা হয়েছিল।
প্রকৃতির মহাশক্তি অভিকর্ষের ওপর গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করে হ্যানি নিউটনের সহযোগিতা প্রার্থনা করলেন।
নিউটন এতদিন তাঁর যে গবেষণার কথা চেপে রেখেছিলেন, তা প্রথম প্রকাশ করলেন হ্যানির কাছে।
জানালেন, বারো বছর আগেই তিনি এ সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন তত্ত্ব আবিষ্কারও করেছেন।
হ্যালির প্রশ্নের উত্তরে তিনি এও জানালেন যে বিশেষ কারণেই তিনি তাঁর আবিষ্কৃত মূল্যবান তত্ত্ব দীর্ঘকাল গোপন করে রেখেছেন।
কারণটিও গোপন করলেন না নিউটন। তার আলোক বিজ্ঞানের ওপর গবেষণা প্রকাশিত হবার পর তাঁকে বহু মিথ্যা সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীও এই দলে ছিলেন।
তাঁদের নীচতা দেখে তাঁর মন এমনই ভেঙ্গে পড়েছিল যে জীবনে আর কোন গবেষণার কথাই প্রকাশ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত করেন।
তরুণ বিজ্ঞানী হ্যানির আগ্রহ ও তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত নিউটন তার গবেষণা প্রকাশ করবেন বলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হলেন।
টানা দুই বছর পরিশ্রম করে তিনি তাঁর যে গবেষণা প্রবন্ধটি তৈরি করেন তা বিশ্ববিজ্ঞানের এক অমূল্য সম্পদ। বইটির নাম রাখা হয় ফিলোসফিয়া নেচারালিস প্রিনসিপিয়া ম্যাথেমেটিকা যা ইংরাজি করলে দাঁড়ায় Mathematical Principle of Natural Philosophy
তরুণ হ্যানি এই সময় নানাভাবে নিউটনকে সাহায্য করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর আগ্রহেই বইটি তৈরি হয়েছিল, প্রকাশও করলেন নিজের পয়সায়।