এইভাবে ক্লার্কের ওষুধ তৈরির ল্যাবরেটরির সন্ধানও পেয়ে যান একদিন। কৌতূহল নিয়ে কাঁচের যন্ত্রপাতি, রসায়নিক বোঝাই শিশি-বোতল সব নাড়াচাড়া করে দেখেন।
এই বাড়ির নিরিবিলি চিলেকোঠায় বসেই সর্বপ্রথম সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠেছিলেন বালক নিউটন।
বাতাসি কলযন্ত্রের গাড়ি, জলঘড়ির নানা মডেল বানিয়েছেন তিনি। কখনও নানা রসায়নিকের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখেছেন।
ক্লার্ক ভবনে নিউটনের সঙ্গী ছিল ক্লার্কের একমাত্র মেয়ে স্টোরি। বন্ধুত্বের সহজ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাদের মধ্যে।
নিউটনের যখন মোল বছর বয়স, তখন উলসথরপ থেকে মায়ের চিঠি পেয়ে জানতে পারেন তার নতুন বাবা মারা গেছেন। জামিদারির ব্যাপার নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন তিনি।
ক্লার্ক পরিবারের চার বছরের জীবনে ছেদ পড়ে এরপর। নিউটন উলসফরপ মায়ের কাছে চলে আসেন।
কিন্তু জমিদারির লাভক্ষতি আর চাষ-আবাদের হিসেবের মধ্যে অল্পদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন নিউটন। মাকে জানালেন কলেজে পড়বেন। লেখাপড়ায় ছেলের আগ্রহ দেখে মা খুশি হন। ছেলেকে পাঠিয়ে দেন কেমব্রিজে। নিউটন ভর্তি হন ট্রিনিটি কলেজে।
এই কলেজে আইজ্যাক ব্যারো নামে অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন খাঁটি জহুরী। নিউটনের সুপ্ত প্রতিভার পরিচয় তার কাছে গোপন রইল না।
ব্যারো নিজে ছিলেন এক প্রতিভা। বিজ্ঞান, বিশেষ করে পদার্থ বিদ্যায় তাঁর ছিল অসামান্য দখল।
নিজস্ব কিছু গবেষণাও ছিল তাঁর। ব্যারোর সুপারিশে কলেজ কর্তৃপক্ষ নিউটনকে অঙ্কে ছাত্রবৃত্তি পড়ার সুযোগ দিলেন।
এই সময় থেকেই অধ্যাপক ব্যানোর প্রেরণায় নিউটনের বিজ্ঞান প্রতিভার উন্মেষ ঘটতে থাকে। নিউটনকে তিনি জ্যামিতি ও আলোকবিজ্ঞানের রহস্যালোকের সন্ধান দেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই গণিতের মূলনীতিগুলো নিউটন চমৎকার রপ্ত করে ফেললেন।
তবে বিশুদ্ধ গণিতের চেয়ে ব্যবহারিক গণিতই তার পছন্দ ছিল বেশি। এই গণিতের মধ্যেই ছিল প্রকৃতি জগৎ ও সৌরবৈচিত্র্যের রহস্যালোকের চাবিকাঠি।
ব্যারোর তত্ত্বাবধানে থেকে নিজের বিচারবুদ্ধি ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ নিয়ে মেতে রইলেন নিউটন।
নিউটন বৃত্তি পান ১৬৬৪ খ্রি:। সেই বছরই গোড়ার দিকে ইংল্যান্ড জুড়ে মহামারীর আকারে দেখা দিল প্লেগ। কাতারে কাতারে লোক মরল। দিশাহারা লোক জন দলে দলে যে যেদিকে পারল শহর ছেড়ে পালাতে লাগল। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। মড়ক-পীড়িত লণ্ডন ছেড়ে উলসথরপের খামার বাড়িতে চলে এলেন নিউটন।
এখানে এসে মায়ের সঙ্গে জমিদারি দেখাশোনার কাজে হাত লাগালেন। তবে পাশাপাশি বিজ্ঞানের গবেষণাও চালিয়ে চললেন।
উলসথরপে দেড় বছর ছিলেন নিউটন। এই সময়ের মধ্যে এক এক করে তিনটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাজ সম্পূর্ণ করলেন।
তার প্রথম আবিষ্কার দ্বিপদতত্ত্ব অর্থাৎ দুই অংশযুক্ত রাশি ও দ্বিতীয় আবিষ্কার প্রভেদক গণনা গণিতের মৌলসূত্র।
এই দুটির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে বাইনোমিরাল থিয়োরেম ও ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস।
প্রভেদক গণনা গণিতের সাহায্যে অনবরত পরিবর্তনীয় রাশির পরিবর্তনের হার বার করা যায়। এই রাশিগুলোর নাম হল প্রবাহপুঞ্জ বা Fluxions।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রবাহপুঞ্জের বিকল্প প্রবাহেরও সন্ধান পেয়ে গেলেন নিউটন। এইভাবেই পাওয়া গেল গণনা গণিতের এক শাখা অখন্ড গণনা গণিত বা ইনটিগ্রাল ক্যালকুলাস।
এই সঙ্গেই আরও একটি কাজ করলেন নিউটন। শংকুর কোন এক অংশ নিয়ে যে বক্ররেখা বা কারভ রচিত হয় সেই পরা বলয়ের ক্ষেত্রফল ও ঘনবস্তুর আয়তনের পরিমাপের উপায়ও বার করে ফেললেন।
এইভাবে জমিদারির কাজ আর নিজের গবেষণা নিয়ে দেখতে দেখতে দেড়টি বছর কেটে গেল। নিউটন আবার কেমব্রিজে ফিরে এলেন।
এখানে এসে তাঁর তিনটি গবেষণা প্রকাশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে গণিত বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে গেল। প্রভেদক গণনা গণিতের উদ্ভাবক হিসাবে বিজ্ঞানী মহল তাকে স্বীকৃতি জানাল।
কোপারনিকাশের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব থেকে নিউটন জেনেছিলেন, গ্রহমণ্ডলী অধিবৃত্ত পথে নিজ নিজ কক্ষে ঘুরপাক খায়। গ্যালিলিওর গতিসূত্র ও চলমান বস্তুর যান্ত্রিকতা সম্পর্কেও তাঁর ধারণা পরিষ্কার ছিল। এই ধারণার ভিত্তিতেই তাঁর দ্বিতীয় আবিষ্কার রূপ পেয়েছিল।
সেইকালে বিজ্ঞানীরা জানতেন না গ্রহরা নিজ নিজ কক্ষপথে কার প্রভাবে নিয়মিতভাবে আবর্তিত হয়ে চলেছে।
নিউটন তার অঙ্কের সাহায্যে বুঝতে পারলেন যে সূত্রের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত বস্তু ও তাদের গতির নিয়ন্ত্রণ ঘটে সেই একই সূত্রের প্রভাবে সৌরজগতের গ্রহতারকাদের কক্ষনির্ভর আবর্তনও নিয়ন্ত্রিত হয়। যে সূত্র বা বলের টানে গাছের আপেল আকাশে না উঠে মাটিতে এসে পড়ে, সেই একই বল সৌরমন্ডলের গ্রহতারাদেরও পরিচালিত করে।
নিউটন এই বলেরই নাম দিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। যে সূত্রের সাহায্যে তিনি এই। বলকে প্রকাশ করলেন তারই নাম হল মাধ্যাকর্ষণ সূত্র বা Law of gravitation।
এরপর নিউটন দেখলেন যেই অভিকর্ষ বলকে কেন্দ্র করে সৌরস্তুদের নড়াচড়া সেই কেন্দ্র থেকে সৌর বস্তুর দূরত্বের বর্গের বিষয়ানুপাতিক। অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে সৌর বস্তুর দূরত্ব যদি বাড়ে অভিকর্ষ কমে আসে, আবার যদি দূরত্ব কমে অভিকর্ষ বলের পরিমাণও বেড়ে যায়।