৬২৭ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরীতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) মাতৃভূমি দর্শন ও পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওনা দেন। কিন্তু পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত। সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যে এ কথাগুলো ও উল্লেখ ছিল যে–(১) মুসলমানগণ এ বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে, (২) আগামী বছর হজ্জে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না, (৩) যদি কোন কাফির স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদীনায় গমন করে তাহলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে মদীনা হতে যদি কোন ব্যক্তি পলায়ন পূর্বক মক্কায় চলে আসে তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না, (৪) প্রথম থেকে যে সকল মুসলমান মক্কায় বসবাস করছে তাদের কাউকে সাথে করে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর মুসলমানগণের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না। আর মুসলমানগণের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না, (৫) আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোর এ স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমনি ও কাফির) মাঝে যাদের সঙ্গে ইচ্ছে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে, (৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে। এছাড়া কুরাইশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন আমর সন্ধিপত্র থেকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং মুহাম্মদুর রাসূলল্লাহ’ বাক্য দুটি কেটে দেয়ার জন্যে দাবি করেছিল। কিন্তু সন্ধি পত্রের লেখক হযরত আলী (রাঃ) তা মেনে নিতে রাজি হলেন না। অবশেষ বিশ্বনবী (সাঃ) সুহায়েল বিন আমরের আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ বাক্য দু’টি নিজ হাতে কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহায়েল বিন আমরের দাবি অনুযায়ী ‘বিছমিকা আল্লাহুম্মা’ এবং কে নির্দেশ দেন। সুতরাং বাহ্যিক দৃষ্টিতে এ সন্ধি মুসলমানদের জন্যে অপমানজনক হলেও তা মুহাম্মদ (সাঃ) কে অনেক সুযোগ সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল। এ সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সাঃ) এর রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে স্বীকার করে নেয়। সন্ধির শর্তানুযায়ী অমুসলিমগণ মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে অমুসলিমগণ ইসলামের মহৎ বাণী উপলব্ধি করতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এ সন্ধির পরই মুহাম্মদ (সাঃ) বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ (সাঃ) যেখানে মাত্র ১৪০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে হুদায়বিয়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র ২ বছর অর্থাৎ অষ্টম হিজরীতে ১০,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন। যে মক্কা থেকে বিশ্বনবী (সাঃ) নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত হয়েছিলেন, সেখানে আজ তিনি বিজয়ের বেশে উপস্থিত হলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে গ্রেফতার করে মুহাম্মদ (সাঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত করেন। কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার এ মহান আদর্শ পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল। মক্কায় আজ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান। সকল অন্যায় অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত।
৬৩১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক দশম হিজরীতে মুহাম্মদ (সাঃ) লক্ষাধিক মুসলিম সৈন্য নিয়ে বিদায় হজ্জ সম্পাদক করেন এবং হজ্জ শেষে আরাফাতের বিশাল ময়দানে প্রায় ১,১৪,০০০ সাহাবীর সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন যা ইসলামের ইতিহাসে “বিদায় হজ্জের ভাষণ” নামে পরিচিত। বিদায় হজ্জের ভাষণে বিশ্বনবী (সাঃ) মানবাধিকার সম্পর্কিত যে সনদপত্র ঘোষণা করেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা আজও অতুলনীয়। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, (১) হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজিকার এ দিন, এ মাস এবং এ পবিত্র নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তেমনি পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ, রক্ত এবং তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের পরস্পরের নিকট। কখনো অন্যের উপর অন্যায় ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না। (২) মনে রেখ, স্ত্রীদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের উপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে।(৩) সাবধান, শ্রমিকের মাথায় ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দিবে। (৪) মনে রেখ, যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না। (৫) চাকর চাকরাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইও না। তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তাই খেতে দিবে; তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তাই (সমমূল্যের) পরিধান করতে দিবে। (৬) কোন অবস্থাতেই ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। এমনি ভাবে মানবাধিকার সম্পর্কিত বহু বাণী তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে পেশ করে যান। তিনি হলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মানবজাতির একমাত্র আদর্শ এবং বিশ্ব জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরিত।