মাইকেলেঞ্জেলো গিয়ে দেখা করলেন সোদেরিনির সাথে। দুজনেই পূর্ব পরিচিত। সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত সোদেরিনি। শেষ পর্যন্ত তার মনে হল কে জানে সমস্ত ইটালিতে এই একমাত্র পুরুষ যে পারবে এই পাথরে ফুল ফোঁটাতে।
মাইকেলেঞ্জেলোর মনে হল শক্তি আর আত্মপ্রত্যয়ের মধ্যেই জন্ম নেবে তার ডেভিড। কাজ শুরু হল। কি নিষ্ঠা আর একাগ্রতা! প্রতিটি মানুষ বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায় কি অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছেন মাইকেলেঞ্জেলো। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা পার হয়ে যায়, অবশেষে শেষ হল বিশাল আকৃতির ডেভিড। ব্যঞ্জনা আর অভিব্যক্তিতে মনে হল বাইবেলের যুগ থেকে ফ্লোরেন্সের মাটিতে উঠে এসেছে এক জীবন্ত ডেভিড।
ডেভিডের কাজ শেষ হবার কিছুদিন পরেই রোম থেকে ডাক এল। এবার আমন্ত্রণ করেছেন স্বয়ং পোপ। সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরেন্স ত্যাগ করে রোমের পথে যাত্রা করলেন মাইকেলেঞ্জেলো।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মাইকেলেঞ্জেলোর। ষড়যন্ত্রে মাসের পর মাস চুপচাপ বসে রইলেন। অবশেষে বিরক্ত হয়ে ফিরে এলেন ফ্লোরেন্সে।
ফ্লোরেন্সে ফিরে আসতেই আবার ডাক এল পোপের কাছ থেকে। বাধ্য হয়ে আবার ফিরে এলেন রুমে।
এবার পোপ আদেশ দিলেন সিসটাইন চ্যাপেলের ভেতরের ছাদে প্রভু যীশু আর তাঁর বারোজন শিষ্যের ছবি আঁকতে হবে।
সিটাইন চ্যাপেল। ভ্যাটিকান সিটির প্রধান চ্যাপেল। আকৃতি আর বৈশিষ্ট্যে বিরাট কেল্লার মত। প্রায় তিনতলা সমান উঁচু। আকাশের মত উঁচু ছাদ।
বিশাল ভারা হল। আঁকার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে ভারা বেয়ে উপরে উঠলেন। উপর থেকে চারদিকে পুরো ছাদটা তিনটে ভাগে বিভক্ত। একপ্রান্তে শুরু হল ১২ জন শিষ্যের ছবি। বাইবেলের বর্ণনা আর ধ্যানের কল্পনা দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে এই ছবি।
তাঁকে সাহায্য করবার কেউ নেই। যারাই আসে, কাজের চাপে পালিয়ে যায়। একা একা কাজ করে চলেন মিকেলেঞ্জেলো। কখনো বসে কখনো শুয়ে, কখনো কাত হয়ে, কখনো হেলে। গায়ের উপর রং ঝড়ে পড়ে, চোখে রঙের ছিটে লাগে। ঘাড় টন টন করে, ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসে।
ভারার উপরেই শুয়ে পড়েন। আঠারো-কুড়ি ঘণ্টা কাজ করতে করতে ভুলে যান সব ক্ষুধা তৃষ্ণা, পোশাক পাল্টাবার কথা, দশ-বারো দিন পর অর্ধমৃত মানুষের মত নেমে আসেন, তারপর আবার উঠে যান। এতটুকু বিশ্রাম নেবার অবকাশ নেই। এ তাঁর সৃষ্টির সাধনা।
এক বছরের মধ্যেই কাজ শেষ হল। প্রথমে চিত্রকরের কাজ বলে যাকে অবহেলা করেছিলেন এখন তাই তাকে গভীরবাবে আকর্ষণ করছে। পোপের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। অন্য দুটি ছাদে আঁকবেন বাইবেলের সৃষ্টির আর ধ্বংসের চিত্র। হাসিমুখে পোপ অনুমতি দিলেন।
প্রথমে শুরু করলেন আদম ইভ আর স্বর্গোদ্যানের চিত্র। ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন পৃথিবী, পানি, আকাশ, জীবজন্তু সব শেষে মানুষ। প্রথম মানুষ আদম ইভের কাহিনী, স্বর্গ থেকে বিচ্যুতি।
দুবছর কেটে গেল এই কাহিনী শেষ করতে। তারপর প্রলয় প্লাবন। সমস্ত পৃথিবী পাপে পরিপূর্ণ তাই ক্রুদ্ধ ঈশ্বর পৃথিবীতে মহাপ্লাবন ডেকে এনেছেন। সবাই ডুবে যাচ্ছে শুধু নোয়া তরণী নিয়ে ভেসে যাচ্ছে।
দীর্ঘ চার বছর বাদে শেষ হল সিসটাইল চ্যাপেলের বিরাট চিত্র। সৃষ্টির ব্যাপ্তিতে গভীরতম উৎকর্ষতায় সিসটাইনের এই চিত্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি।
নতুন পোপের অনুরোধে ফ্লোরেন্সে ফিরে গিয়ে মেদিচি পরিবারের জন্য তৈরি করলেন দুটি সমাধি মন্দির। উপরে মেদিচি পরিবারের দুজনের প্রতিমূর্তি। নিচে একদিকে দুটি নারীমূর্তি। তারা ঊষা আর রাত্রি। অন্যদিকে দুটি পুরুষমূর্তি সন্ধ্যা আর দিন–বেঁনেসার প্রাণসত্তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে এই মূর্তিগুলোর মধ্যে।
ফ্লোরেন্সের কাজ শেষ করে ফিরে এলেন রোমে। তখন নতুন পোপ হয়েছেন তৃতীয় পল। লরেঞ্জের আদর্শে মানুষ মাইকেলেঞ্জেলোকে ডেকে বললেন, তুমি আগেকার পোপেদের অমর করেছ তোমার সৃষ্টির মধ্যে। এবার আমার ইচ্ছা পূর্ণ কর। তুমি জান সিসটাইন চ্যাপেলের সবচেয়ে বড় দেওয়ালটা এখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে, ওখানে তুমি শেষ বিচারের ছবি আঁক। আমি মনে করি তুমিই ইটালির শ্রেষ্ঠ শিল্পী, তুমিই পারবে এই কাজ করতে।
ছবি দেখে দুচোখ আঙুল চাপা দিল সকলে। ছি ছি প্রভু যীশু মাতা মেরী কারো গায়ে একটু টুকরো পোশাক নেই। এ দেখাও পাপ। প্রতিবাদের গুঞ্জন উঠল চারদিকে, কিন্তু পোপের সমর্থন থাকায় মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর শেষ হল শেষ বিচার।
শেষ বিচারের পর্বেই মাইকেলেঞ্জেলোর জীবনে এলেন ভিত্তোরিয়া। রোমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। বিদুষী কবি ধর্মীয় সাধিকা। বয়স ছেচল্লিশ।
জীবনের প্রৌঢ় বেলায় (তেষট্টি বছর বয়সে) মাইকেলেঞ্জেলোর সাথে আলাপ হল ভিত্তোরিয়ার। প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হলেন। তাঁর ব্যথাভরা দিনগুলোর কথা শুনতে শুনতে নিজের অন্তরে অনুভব করলেন গভীর আকর্ষণ। এতদিন শিল্পের জন্যেই জীবনের প্রতি তার ছিল আকর্ষণ, এবার এল মানবীয় বোধ।
রাতের বেলায় মোমবাতির সামনে বসে একটা কবিতা লিখলেন। কতদিন কবিতা লেখেননি। ভিত্তোরিয়া তার মনের মধ্যে সেই কবিসত্তা আবার জাগিয়ে তুলেছে। শুরু হল কবিতা লেখা লোহার মত কঠিন হাত থেকে এবার ঝরে পড়তে থাকে প্রভাতের মত স্নিগ্ধ সনেটগুচ্ছ।