কয়েকদিন পর স্কালচার গার্ডেনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন লরেঞ্জ দ্য মেদিচি। এখানকার প্রতিটি মূর্তি তার চেনা কিন্তু এই নতুন মূর্তিটি কোথা থেকে এল। দাঁড়িয়ে পড়লেন লরেঞ্জ। তাকে দেখেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন মিকেলেঞ্জলো। তাঁর দিকে ফিরে লরেঞ্জ বললেন, কে এই মূর্তি তৈরি করেছে?
–ইওর এক্সলেন্সী! আমি এই মূর্তি তৈরি করেছি।
-তোমার ফনকে দেখে তো মনে হচ্ছে বৃদ্ধ তাই না? বৃদ্ধ মানুষের মুখে কি সব ক’টা দাঁত থাকে?
থমথম খেয়ে গেলেন মাইকেলেঞ্জেলো। একথা তো তার মনে আসেনি। কিছু বলার আগেই মেদিচি তার পিঠে সামান্য চাপড় মেরে এগিয়ে গেলেন।
লরেঞ্জ চলে যেতেই কয়েক মুহূর্তে চিন্তা করলেন মাইকেলেঞ্জেলো, তারপর ছেনি তুলে নিলেন। পরদিন বাগানে আসতেই ফনের মূর্তির দিকে চোখ পড়ল লরেঞ্জের। তার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বারতোলদো। লরেঞ্জ তাকে বললেন, কি ব্যাপার, একদিনে ফনের বয়স মনে হচ্ছে কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। ওপরের দুটো দাঁত নেই, নিচের একটা দাঁত নেই, মুখের উপরে চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, এতটুকু ভুল নেই কোথাও।
বারতোলদো বললেন, গতকাল আপনি চলে যাবার কিছুক্ষণ পর মাইকলেঞ্জেলো এই কাজ করেছে।
মুগ্ধ হলেন লরেঞ্জ। বললেন, এখন থেকে ওকে আর বাইরে থেকে যাতায়াত করতে হবে না। ও আমার প্রাসাদে আমার পরিবারের সঙ্গেই থাকবে। এখান থেকেই ও সব কিছু শিখবে।
মেদিচি প্রাসাদ। শুরু হল মাইকলেঞ্জেলোর নতুন জীবন। এখানে কবি শিল্পী সাহিত্যিক, দার্শনিকদের সান্নিধ্য এগিয়ে চলল তার সাধনা।
হঠাৎ ফ্লোরেন্সের মাটিতে আবির্ভূত হল এক মূর্তিমান কালাপাহাড়। ফ্লোরেন্সের প্রধান গীর্জার যাজক হিসাবে নির্বাচিত হয়েই সাভানারোল হুঙ্কার ছাড়লেন, মেদিচিরা স্বৈরাচারী, তারা শিল্পের নামে সাহিত্যের নামে যা করছে তা ধর্মবিরুদ্ধ। বর্তমানে মানুষ যা করছে তা অন্যায়, পাপ।
মাইকেলে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ক্রমশই সাভানারোলের প্রভাব বেড়ে চলে। লরেঞ্জ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অবস্থার মধ্যেই মাইকেল দুটি মূর্তি তৈরি করলেন– ম্যাডোনা, সেন্টারের যুদ্ধ। আর একটি নতুন মূর্তির কাজে হাত দিয়েছেন এমন সময় খবর এল লরেঞ্জ মারা গিয়েছেন। লরেঞ্জের বড় ছেলে পিয়েরো তার পিতার আসনে বসলেন। তবু মিকেলের মনে হল তাঁর জীবনের আদর্শ পুরুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এ আসন আর পূর্ণ হবার নয়।
মাইকেলের মনে হল আর এখানে থাকা সম্ভব নয়, রওনা হলেন বেলেনায় কিন্তু সেখানেও অশান্তির আগুন। আবার ফ্লোরেন্সে ফিরে এলেন।
নিজের কাছে সামান্য যেটুকু অর্থ ছিল তাই দিয়ে কিনলেন একটুকরো পাথর। কয়েকদিনের মধ্যেই তাই দিয়ে তৈরি করলেন এক “কিউপিড” এক শিশুমূর্তি মাথার তলায় হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এক বন্ধু পরামর্শ দিল পুরনো জিনিস বলে বেঁচে দাও, ভাল দাম পাবে। মাইকেলেঞ্জেলো তাতে সায় দিলেন, ব্যবসাদার বন্ধু তখন নিজেই কিনে নিলেন। রোমে গিয়ে কার্ডিনাল রিয়ারিয়োকে বিক্রি করবার সময় ধরা পড়ে গেলেন। বিরারিয়ো বুঝতে পারলেন, এটি কোন প্রাচীন শিল্পকর্ম নয়। কিন্তু তার ভাল লাগল মূর্তির কাজ। শিল্পীকে দেখার আকাঙ্ক্ষায় লোক পাঠালেন ফ্লোরেন্সে।
শেষ পর্যন্ত পোপের আদেশে সাভনারোলোকে বন্দী করা হল। অসহ্য নিপীড়ন করে ১৪৯৮ সালের ২৩ মে সাভানারোলকে পুড়িয়ে মারা হল। শেষ হল দুঃস্বপ্নের যুগ। কিন্তু সেখানে থাকতে আর মন চাইছিল না মাইকেলেঞ্জেলোর। এমন সময় রোম থেকে কার্ডিনালের ডাক এল। আর অপেক্ষা করলেন না। যাত্রা করলেন রোমের উদ্দেশ্যে।
কার্ডিনাল রিয়ারিয়ে তাকে একটা ৭ ফুট পাথর দিয়েছেন, কিন্তু কাজ আরম্ভ করবার অনুমতি দেননি।
মাইকেলেঞ্জেলোর মনে হল আর কিছুদিন এভাবে বসে থাকলে এতদিন ধরে যা কিছু শিখেছিলেন তার সব কিছু ভুলে যাবেন। মনের আনন্দে দিনরাত কাজ করে চলেন। মাত্র তিনদিনে শেষ হল কিউপিড। ছোট্ট এক শিশু, একরাশ উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে আছে তার কচিমুখে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন। হঠাৎ একদিন রোমের রাজপথে দেখা হল বালদুচ্চির সঙ্গে। ছেলেবেলাকার বন্ধু এখন রোমের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার ইয়াকোপো গাল্লির কর্মচারি। মাইকলেঞ্জেলোর কিউপিড দেখেই বালদুচ্চি বলে ওঠে এ মূর্তি তুমি আমার মনিব গাল্লির কাছে নিয়ে চল।
মূর্তি দেখে বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গাল্লি। এই মূর্তির জন্য তিনি ৭৫ ডুকাট দিলেন। একটি ছোট মূর্তির জন্য ৭৫ ডুকাট! আনন্দে তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
গাল্লি শুধু তাকে উৎসাহ দিলেন না, নিজের বাগানবাড়িতে আশ্রয় দিলেন। তাঁর ভরণপোষণের সব ব্যয়ভার করলেন।
তারই চেষ্টায় বড় কাজের দায়িত্ব পেলেন। একজন বৃদ্ধ কার্ডিনাল তাঁর উপাসনা কক্ষের জন্যে একটা মূর্তি গড়তে চেয়েছেন।
মাইকেলেঞ্জেলো নাম দিলেন পিয়েটা অর্থাৎ বেদনা। শুরু হল পিয়েটা, একটু একটু করে পাথরের বুক চিরে বেরিয়ে এল প্রথমে মেরীমাতা তারপর তার কোলের উপর শয়ন মৃত যীশু।
পাঁচ বছর কেটে গেল। অন্তরে মাতৃভূমি ফ্লোরেন্সের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন মাইকেলেঞ্জেলো। একদিন শেষ রাতে রওনা হলেন ফ্লোরেন্সের দিকে।
ফ্লোরেন্সে এসেই মাইকেলেঞ্জেলো শুনলেন সতেরো ফুট লম্বা বিরাট একটা পাথর দিয়ে চারদিকে বহু আলোচনা চলেছে। এর মালিক স্থানীয় উল ব্যবসায়ী সমিতি কিছুতেই স্থির করতে পারছিলেন না, তারা এই বিরাট এবড়ো-থেবড়ো মার্বেল পাথরটিকে নিয়ে কি করবেন।