সুপ্রজনন বিজ্ঞান-প্রাচীন গ্রীসের মানুষেরা সুস্থ সবল দেহের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিত। তারা দুর্বল অসুস্থ শিশুকে জীবিত রাখবার পক্ষপাতী ছিলেন না। প্লেটো এই অভিমত সমর্থন করতেন। তাই তিনি বলেছেন, যাদের শরীর ব্যাধিগ্রস্থ তাদের কোন সন্তান প্রজনন করা উচিত নয়। আপাত দৃষ্টিতে প্লেটোর অভিমত নিষ্ঠুর বলে মনে হলেও সামাজিক বিচারে তা একেবারে মূল্যহীন নয়। সংগীতের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর আকর্ষণ। তিনি বিশ্বাস করতেন সংগীত মানব জীবনকে পূর্ণতা দেয়, মানবিক গুণকে বিকশিত করে। নারীদের প্রতি প্লেটোর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাদের শিক্ষা সম্বন্ধে তিনি উদার নীতিতে বিশ্বাস করতেন। সেই যুগে অনেক মহিলাই পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে করতেন পুরুষেরা অহমিকাবশত নারীদের উপেক্ষা করে। গ্রীসের পুরুষদের এই অহমিকা প্লেটোকে স্পর্শ করেনি। তিনি দেখেছেন বিভিন্ন গ্রীক মনীষীদের প্রেরণার উৎসই হচ্ছে নারী।
প্লেটো তাঁর আইন সমস্ত শিক্ষার মধ্যে দিয়ে এক আদর্শ রাষ্ট্র, মানব সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জীবনের অন্তিম পর্বে এসে বাস্তবের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন, রিপাবলিকের মধ্যে তিনি যে রাষ্ট্রের যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন তা কোনদিনই বাস্তব হওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি লিখলেন তার আইন (Laws) গ্রন্থ। এতে মানুষের বাস্তব প্রয়োজন, তার কল্যাণের কথা চিন্তা করে রাষ্ট্রের আদর্শের কথঅ বলেছেন। দার্শনিক প্লেটোর আরেক দিক তার কবিসত্তা। তাঁর প্রবন্ধগুলোর মধ্যে একদিকে যেমন প্রকাশ পেয়েছে জ্ঞান, গভীরতা, প্রজ্ঞা… অন্যদিকে ফুটে উঠেছে অন্যতম লালিত্য। দর্শনের ভাষা যে এমন প্রাণবন্ত, কাব্য সৌন্দর্যে অতুলনীয় হয়ে উঠতে পারে, প্লেটোর রচনা না পড়লে তা অনুভব করা যায় না। প্লেটো কবিদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না কিন্তু তাঁর রচনার মধ্যে কবি আর দার্শনিকসত্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। তাই তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রাসেল বলেছেন, “প্লেটো ভাবুক ছিলেন না- ছিলেন কলাকুশলী। তাঁর প্রতিটি রচনাই সাহিত্যক নিপুণতার এক উৎকৃষ্ঠ নিদর্শন। কোথাও তার রচনা নাটকীয়, কোথাও ঐতিহাসিক ঘনঘটায় আচ্ছন্ন। ভোরের আলোছায়ার মত তার রচনায় হাস্যরস, গাম্ভীর্য, করুণ রস একই সাথে পরস্পরকে অনুগমন করেছে। বিষয় বৈচিত্র্যে রচনাশৈলীর সৌন্দর্য আর বিশুদ্ধতার প্লেটোর নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টাদের পাশে অমর হয়ে থাকবে।”
প্লেটো ছিলেন একেশ্বরবাদী। তাঁর ঈশ্বর মঙ্গলময়, তিনি মানুষের কল্যাণ করেন। তিনি পূজা পাঠ উপাসনাকে স্বীকার করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রদ্ধা আর পবিত্র চরিত্র। সেই সাথে প্রজ্ঞা, জ্ঞানের মাধ্যমেই ঈশ্বরের পূজা করতে হয়।
একদিন তার এক বন্ধুর ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার কলকোলাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। বিশ্রাম নেবার জন্য পাশের ঘরে গেলেন কিন্তু আনন্দ উল্লাসের শব্দ ক্রমশই বেড়ে চলছিল। উপস্থিত সকলেই ভুলে গিয়েছিল বৃদ্ধ দার্শনিকের কথা। এক সময় বিবাহ শেষ হল। নব দম্পতি আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য প্লেটোর কক্ষে প্রবেশ করল। প্লেটো তখন গভীর ঘুমে অচেতন। পৃথিবীর কোন মানুষের ডাকেই সে ঘুম ভাঙাবে না।
৯৯. মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪)
পুরো নাম মাইকেলেঞ্জেলো বুয়োনারত্তি। বাবার নাম লোদভিকো। মাইকেলেঞ্জেলোর জন্মের ১৪৭৫ পরেই তার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়েই তার জন্যে ধাত্রী নিয়োগ করা হল। ধাত্রী একজন পাথর খোদাইকারীর স্ত্রী। নিজেও অবসরে পাথরের কাজ করতো।
ছয় বছর বয়সে মা মারা গেলেন মাইকলেঞ্জেলোর। তিন বছর এক অস্থির টানাপোড়েনে কেটে গেল। দশ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেন। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে পাশ করার পর ব্যবসা করবে। কিন্তু ছেলের ইচ্ছে অন্য রকম, পাড়ার একটি ছেলে গিরলানদাইও নামে এক শিল্পীর কাছে ছবি আঁকা শেখে।
একদিন বাবার কাছে প্রসঙ্গটা তুলতেই লোদভিকো গর্জে উঠলেন। কিন্তু মিকেলেঞ্জেলোর প্রচণ্ড আগ্রহের কাছে শেষ পর্যন্ত তাকে মাথা নত করতে হল। ১৩ বছর বয়সে ভর্তি হলেন গিরলাদানাইওর স্টুডিওতে। স্কুলের পড়া শেষ হল, শুরু হল ছবি আঁকা।
বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। একদিন ঘুরতে ঘুরতে মাইকেলেঞ্জেলো এসে পড়লেন মেদিচি (ফ্লোরেন্স গণরাষ্ট্রে নির্বাচিত প্রধান) প্রাসাদের কাছে। চোখে পড়ল স্কালপচার গার্ডেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। কি অপূর্ব সব মূর্তি সাজানো রয়েছে চারদিকে। দেহের আকৃতি চোখের তারায় মুখের ভাবে তারা যেন এক রক্ত মাংসের প্রতিমা। কিছুদিনের মধ্যেই ডাক পেলেন ভাস্করদের স্কুল থেকে।
*****
কি মূর্তি পড়বেন মাইকেলেঞ্জেলো! হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা বইতে পড়েছিলেন প্রাচীন রোমের অরণ্য দেবতা ফনের কথা। অর্ধেক মানুষ অর্ধেক পশু। চোখ বুজতেই মনের কল্পনায় ফুটে উঠল সেই রূপ, চকখড়ি দিয়ে পাথরের উপর আঁকতে বসলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফনের বিচিত্র চেহারা ফুটে উঠল পাথরের উপর।
তিনদিন অবিশ্রান্ত কাজ করার পর শেষ হল মূর্তি। যেন জীবন্ত ফন পৌরাণিক জগৎ থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে স্কালপচার গার্ডেনে।