বিচারের নামে মিথ্যা প্রহসন করে সক্রেটিসকে হত্যা করা হল। সক্রেটিসের মত্যু হল কিন্তু তার প্রজ্ঞার আলো জ্বলে উঠল শিষ্য প্লেটোর মধ্যে। প্লেটো শুধু যে সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন গুরুর জ্ঞানের ধারক-বাহক। গুরুর প্রতি এত গভীর শ্রদ্ধা খুব কম শিষ্যের মধ্যেই দেখা যায়। প্লেটো যা কিছু লিখেছেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর প্রধান নায়ক সক্রেটিস। এর ফলে উত্তর কালের মানুষদের কাছে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সক্রেটিসকে কেন্দ্র প্লেটো তাঁর সব সংলাপ তত্ত্বকথা প্রকাশ করেছেন। সবসময়েই প্লেটো নিজেকে আড়ালে রেখেছেন-কখনোই প্রকাশ করেননি। সক্রেটিসের জীবনের অন্তিম পর্যায়ের যে অসাধারণ বর্ণনা করেছেন প্লেটো তার “সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিন” গ্রন্থে, জগতে তার কোনো তুলনা নেই।
প্লেটোর মত প্রতিভাবান পুরুষ যে শুধুমাত্র সক্রেটিসকে অন্ধ অনুসরণ করে তার অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন, এ কথা মেনে নেওয়া কষ্টকর। তাঁর কথোপকথনগুলো দীর্ঘকাল ধরে রচনা করা হয়েছে। প্লেটোর মত একজন মহান চিন্তাবিদ দার্শনিক সমস্ত জীবন ধরে শুধু সক্রেটিসের বাণী প্রচার করবেন, একথা কখনই মেনে নেওয়া যায় না। তাই পণ্ডিত ব্যক্তিদের ধারণা, প্লেটো তার নিজের অভিমতকেই প্রকাশ করেছেন। তার এই সব অভিমতের উৎস ও প্রেরণা হচ্ছে সক্রেটিসের জীবন ও তাঁর বাণী।
গুরুর মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন প্লেটো। তার কয়েক বছরের এথেন্স স্পার্টার হাতে সম্পূর্ণ হাতে বিধ্বস্ত হল। আর এথেন্সে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি যখন যে দেশেই গিয়েছেন সেখানকার জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিতদের সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করতেন। এতে একদিন যেমন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের প্রসার ঘটছিল, অন্যদিকে তেমনি পণ্ডিত দার্শনিক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সম্মান ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে প্রবাসে জীবন কাটিয়ে অবশেষে ফিরে এলেন। এথেন্সে।
মহান শুরুর মহান শিষ্য। ভ্রমর যেমন ফুলের সুবাসে চারদিকে থেকে ছুটে আসে দলে দলে, ছাত্ররা এসে ভিড় করল প্লেটোর কাছে। সক্রেটিস শিষ্যদের নিয়ে প্রকাশ্য স্থানে গিয়ে শিক্ষা দিতেন কিন্তু প্লেটো উন্মুক্ত কল-কোলাহলে শিক্ষাদানকে মেনে নিতে পারতেন না। নগরের উপকণ্ঠে প্লেটোর একটি বাগানবাড়ি ছিল, সেখানেই তিনি শিক্ষাকেন্দ্র, খুললেন, এর নাম দিলেন একাডেমি। এই একাডেমির ছাত্রদের কাছেই প্লেটো উজাড় করে দিলেন তার জ্ঞান চিন্তা মনীষা। তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সিসিলি দ্বীপের শাসকদের আহবানে তিনি উপদেষ্টা হিসাবে সেখানে যান। তিনি চেয়েছিলেন সিসিলিকে এক আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করতে। দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার সাথে রাষ্ট্রনেতাদের চিন্তাভাবনার কোনদিনই মিল হয় না। তাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে এলেন এথেন্সে। তার এই অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন রিপাবলিক-এক আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে। আসলে প্লেটোর আগে দর্শনশাস্ত্রের কোন শৃঙ্খলা ছিল না। তিনিই তাকে একটি সুদৃঢ় ভিক্তির উপর প্রতিষ্ঠা করলেন। তাকে নতুন ব্যঞ্জনা দিলেন। তিনি জীবনব্যপী সাধনার মধ্যে দিয়ে মানুষকে দিয়েছেন এক নতুন প্রজ্ঞার আলো। ইউরোপ তাঁকে বর্জন করলেও আরবরা তাঁকে গ্রহণ করল। আরব পণ্ডিতরা তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল। আবার চারদিকে প্রচারিত হল তার আদর্শবাদ। ইউরোপের মানুষের চিন্তাভাবনা মননের জগতে যে দুজন মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তাদের একজন প্লেটো, অপরজন অ্যারিস্টটল।
প্লেটোর চিন্তাভাবনা তাঁর যুগকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে এক চিরকালীন সত্য। প্লেটোর চিন্তাভাবনার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে তার রিপাবলিক গ্রন্থে। বিশ্ব সাহিত্যেল এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যদিও বইখানিতে মূলত রাষ্ট্রনীতির আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনে এখানে নানান প্রসঙ্গ এসেছে। মানব জীবন এবং সমাজ জীবনে যা কিছু প্রয়োজন শরীরচর্চা, শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, এমনকি সুপ্রজনন বিদ্যা। এছাড়াও কাব্য অলঙ্কার নন্দন তত্ত্ব এই বইয়ের অন্তর্ভূক্ত। প্লেটো রাষ্ট্রের নাগরিকদের তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- (১) শাসক সম্প্রদায়, (২) সৈনিক, (৩) জনসাধারণ ও ক্রীতদাস।
রাষ্ট্র তখনই সুপরিচালিত হয় যখন তিন বিভাগের কাজের মধ্যে সুসামঞ্জস্য বর্তমান থাকে এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। তিনি বলেছেন শাসক সম্প্রদায়ের প্রয়োজন জ্ঞান, শাসন ক্ষমতা- সৈনিকদের চাই সাহস বীরত্ব, জনগণের প্রয়োজন সংযম ও শাসকদের প্রতি আনুগত্য। রাষ্ট্রের উন্নতি-অবনতি অনেকাংশে নির্ভর করে শাসকদের উপর। তাই প্লেটো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন শাসক নির্বাচনের উপর।
তিনি বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় কোন স্বৈরাচারীর স্থান নেই। “রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শুধু জীবন ধারণের জন্য নয়। যতদিন মানুষ জীবিত থাকবে ততদিনই সে শ্রেষ্ঠ জীবন যাপন করবে।” তার রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চ-নীচের ভেদ থাকবে না, থাকবে পারস্পরিক সৌহার্দ ও প্রীতির সম্পর্ক। দি লস গ্রন্থে তিনি বলেছেন, নগরবাসীরা সকলে পরস্পরকে জানবে বুঝবে। এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আর কিছুই হতে পারে না।