বিবাহের এক বছর পর ১৭৯৫ সালের অক্টোবর মাসে টমাসের প্রথম সন্তানের জন্ম হল। যথাসময়ে শিশুর নামকরণ করা হল জন কিটস।
কিটসের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই জন হল তার দুই ভাই জর্জ আর টমের। তিন ভাইয়ের মধ্যে কিটস্ ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর।
সাত বছর বয়সে তাঁকে এনফিল্ডের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল।
কিটসের তখন নয় বছর বয়স। জীবনে প্রথম আঘাতের মুখোমুখি হলেন। ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেলেন টমাস কিটস।
স্বামীর মৃত্যুর পর কিটসের মা রলিস নামে একজনকে বিয়ে করলেন। কিন্তু অল্পদিনেই দুজনের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরল। এক বছরের মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি এলেন কিটসের মা। কিটস তখন দশ বছরের ছেলে।
১৮১০ সালে মারা গেলেন কিটসের মা। মরবার আগে নিজের অজান্তেই রাজরোগ যক্ষ্মার বীজ দিয়ে গেলেন সন্তানকে।
মায়ের মৃত্যুর পর পিতৃ-মাতৃহীন ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিলেন মিস্টার এ্যাবি। স্কুলে এলেন কিটস্। দিন-রাত পড়াশুনা নিয়ে থাকেন মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন। ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়া শেষ হল। কিটসের অভিভাবকের ইচ্ছা কিটস্ ডাক্তারি পড়বেন।
ডাক্তারি পড়বার জন্যে ভর্তি হলো মেডিকেল কলেজে। কিন্তু যাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠেছে কবিতার নেশা, হাসপাতালেল ছুরি কাঁচি ঔষধ রুগী তার ভাল লাগবে কেন। সৌভাগ্য সেই সময় তার স্কুলের বন্ধু কাউডেন ক্লার্ক কিটসকে নিয়ে গেলেন সেই সময়কার খ্যাতিমান তরুণ কবি লে হান্টের কাছে।
হান্টের সাথে পরিচয় ১৮১৬ সালে। কিটসের জীবনে এ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হান্ট কিটসের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন, তাঁকে আরো কবিতা লেখবার জন্যে উৎসাহিত করলেন। হান্ট একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই পত্রিকাতেই কিটসের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হল। এখানে কিটসের পরিচয় হল শেলীর সাথে।
আর ডাক্তারির মোহে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারলেন না। অভিভাবকের উপদেশ অগ্রাহ্য করে মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দিয়ে স্থির করলেন সাহিত্যকেই জীবনের পেশা হিসাবে গ্রহণ করবেন।
কিটস্ তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে লন্ডন ত্যাগ করে এলেন হ্যাঁম্পস্টেডে। এখানে আসবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হান্টের সঙ্গ পাওয়া।
অল্পদিনের মধ্যে কিটস্ প্রকাশ করলেন তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন। সকলের মনে আশা ছিল এই বই নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কিটসের পরিচিত কিছু লোকজন ছাড়া এই বই-এর একটি কপিও বিক্রি হল না।
প্রথম কাব্য সংকলনের ব্যর্থতায় সাময়িক আশাহত হলেন কিটস্ কিন্তু অল্পদিনেই নতুন উৎসাহে শুরু করলেন কাব্য সাধনা। লেখা হল প্রথম দীর্ঘ কবিতা এণ্ডিমিয়ন। (Endumion 1817) এ এক অসাধারণ কবিতা। এই কবিতার প্রথম লাইনের মধ্যেই কিটসের জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে–
A Thing of beauty is joy forever.
ইতিপূর্বে কখনো দেশভ্রমণে যাননি কিটস্, তাই বন্ধুর সাথে বেরিয়ে পড়লেন। ভ্রমণ শেষ করে আসতেই দেখলেন তার ভাই টম গুরুতর অসুস্থ।
প্রকাশিত হল তার এণ্ডিমিয়ন ১৮১৭। কিটস আশা করেছিলেন তাঁর এই কবিতা নিশ্চয়ই খ্যাতি পাবে। কিন্তু তৎকালীন দুটি পত্রিকা ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্লি রিভিযু তীব্র ভাষায় কিটসের নামে সমালোচনা করল। জঘন্য সে আক্রমণ। এই তীব্র বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে কিটসের মানসিক শক্তিতে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।
একদিকে যখন পত্রিকার সমালোচনায় ভেঙে পড়েছেন কিটস্, সেই সময় এল আরেক আঘাত। ১৮১৮ সালের ১ ডিসেম্বর মারা গেল টম।
এই সময় কিটসের জীবনের এল ফ্যানি ব্রন, সুন্দরী প্রাণোচ্ছল তরুণী। ফ্যানি তার মায়ের সাথে ব্রাউনের বাড়ি ভাড়াটিয়া হয়ে এসেছিল। কয়েক দিনের পরিচয়ে ভাল লেগে গেল দুজনের। কিটস্ ফ্যানিকে বিবাহ করতে চাইলেন। ফ্যানি সম্মত হলেও সংসারর অভিজ্ঞ মিসেস ব্রন তৎক্ষণাৎ কোন সম্মতি দিলেন না। বললেন, আগে কিটস্ স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক তার পর বিয়ে হবে।
কিটস্ স্থির করলেন যেমন করে হোক তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে। স্বাস্থ্য আগের মত ভাল যাচ্ছিল না। কিন্তু মনের অদম্য শক্তিতে কিটস্ লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। প্রকৃতপক্ষে কিটসের জীবনের সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিতাই এক সময়ে লেখা।
আর্থিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছিল না কিটসের। কিটসের শরীর যতই ভেঙে পড়ছিল ততই ফ্যানি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। তার সাজ-গোজ হাসি অন্য ছেলেদের সাথে মেলামেশা কিটস সহ্য করতে পারতেন না। তার সমস্ত অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত।
তিনি ফিরে এলেন লন্ডনে। একদিন বাইরে বেড়াতে বেরোলেন কিটস। বাড়িতে ফিরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল, সেই সাথে কাশি। এক ঝলক রক্ত উঠে এল মুখ দিয়ে। কিটস্ বললেন, একটি মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে এস। ব্রাউন মোমবাতি নিয়ে আসতেই কিটস্ কিছুক্ষণ রক্তের দিকে চেয়ে বললেন, এই রক্তের রং আমি চিনি, এ রক্ত উঠে এসেছে ধমনী থেকে। এই রক্ত আমার মৃত্যুর শমন।
ডাক্তার এল। সে যুগে যক্ষ্মার কোন চিকিৎসা ছিল না। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে শিরা কেটে কিছুটা রক্ত বার করে দেওয়া হল। কিন্তু তাতে কোন সুফল দেখা গেল না।
তখন তার বয়স মাত্র পঁচিশ। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই জ্বর হত, গলা দিয়ে রক্ত উঠে আসত, এই সময় তাঁর সৃষ্টির উৎসও ফুরিয়ে আসছিল।