লিঙ্কন মনেপ্রাণে ছিলেন দাসপথার বিরোধী। তিনি পার্লামেন্টের সভায় কলম্বিয়া প্রদেশে দাস ব্যবসা বন্ধ করবার জন্য একটি বিল উত্থাপন করলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরোধিতায় সেই বিল অগ্রাহ্য হল।
এরপর রাজনৈতিক জগৎ সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেন লিঙ্কন। তিনি স্প্রিংফিল্ডে এসে আবার আইন ব্যবসায় আরম্ভ করলেন। রাজনীতিতে ফিরে যাবার ইচ্ছা হারিয়ে ফেললেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন তিনি রাজনীতির অঙ্গন থেকে দূরে সরে থাকতে পারলেন না।
নিগ্রো ক্রীতদাসদের প্রতি অত্যাচার অবিচার দেখে বিচলিত হয়ে তিনি এই অমানবিক ব্যবসার বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠলেন।
দৃঢ়স্বরে তিনি এই অভিমত প্রকাশ করলেন যে দেশের অর্ধেক মানুষ যখন ক্রীতদাস তখন স্বাধীনতা এক নির্মম রসিকতার নামান্তর। কোন জাতি এভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। সংগঠিতভাবে প্রতিবাদ জানাবার উদ্দেশ্যে লিঙ্কন নিজের উদ্যোগে রিপাবলিক পার্টি নামে এক নতুন দল গঠন করলেন। পার্টির সংগঠক হিসাবে তিনি দলের রাজনৈতিক আদর্শের কথা যুক্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ বাষায় দেশবাসীর কাছে ব্যাখ্যা করলেন। এই সময় থেকেই লিঙ্কনের নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ইতিমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলো দাস প্রথার সমর্থনের প্রশ্ন তুলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হবার দাবি তুলল। ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ডগলাস দাসপ্রধান সমর্থনে সোচ্চার হলেন। লিঙ্কন তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ জানালেন।
এইভাবে যৌবনের প্রতিদ্বন্দিতা আবার দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করল। লিঙ্কন ও ডগলাসের বিতর্ক বাদানুবাদ দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলল। কিন্তু দুজনেই সমান বাগী। তবে লিঙ্কনের বক্তব্যে থাকত নৈতিকতা, আদর্শবোধ ও দেশপ্রেম। যুক্তির সঙ্গে আবেগ। সহজেই তার বক্তব্য মানুষের হৃদয় স্পর্শ করত।
লিঙ্কন দক্ষিণাঞ্চলের দাবি নস্যাৎ করে ঘোষণা করলেন, আমেরিকা এক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এরপর রিপাবলিকান দলের হয়ে লিঙ্কন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন প্রার্থী হলেন। আর ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে প্রার্থী হলেন ডগলাস।
নির্বাচনে রাষ্ট্রের নেতৃত্বের দায়িত্ব জনগণ লিঙ্কনের হাতেই তুলে দিল। লিঙ্কন নির্বাচনে জিতলেন। ডগলাস হেরে গেলেন। লিঙ্কন হলেন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট।
১৮৬১ খ্রি: লিঙ্কন সস্ত্রীক স্পিফিল্ড ছেড়ে ওয়াশিংটনে চলে এলেন। মার্চ মাসের ৪ তারিখে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি শপথ নিলেন। সেদিনই তিনি ঘোষণা করলেন, দেশ থেকে দাস প্রথা উৎখাত করতে হবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই দেশ বিভক্ত হবে না।
দক্ষিনের রাষ্ট্রগুলোর টনক নড়ল। তারা বঝতে পারল এবারে দক্ষিণের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাউথ ক্যারোলিনার নেতৃত্বে আলবামা, ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, লুসিয়ানা, টেক্সাস ও জর্জিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা এক যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হল। এই নবঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন জেফারসন ডেভিস।
বাধ্য হয়েই দেশকে অখন্ডিত রাখার জন্য লিঙ্কন দক্ষিণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। করলেন। শুরু হয়ে গেল আমেরিকায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।
এই যুদ্ধের প্রথম লক্ষ ছিল ইউনিয়নের রক্ষা। দ্বিতীয় হল দাসপ্রথা উচ্ছেদ। কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর রাজনৈতিক দলাদলির সৃষ্টি হয়ে গেল। চূড়ান্ত বেসামাল অবস্থার মধ্যেও দৃঢ় হাতে হাল ধরে রইলেন লিঙ্কন। তারপর ১৮৩৬ খ্রি: ১লা জানুয়ারী চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণা করে আইনত দাসপ্রথার অবসান ঘটালেন তিনি।
এরপর লিঙ্কন দেশের উত্তর অঞ্চলের সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব অর্পন করলেন গ্র্যান্ট নামে এক প্রাক্তন ক্যাপ্টেনের হাতে। গ্রান্টের লৌহকঠিন দৃঢ়তা ও সাহসিকতা মুগ্ধ করেছিল তাঁকে।
গ্র্যান্ট অল্প দিনের মধ্যেই ডোনেলসন দুর্গের অধিকার করায়ত্ত করে ঝটিকা আক্রমণে দক্ষিণের কয়েকটি শহর দখল করে নেন। অবশেষে দক্ষিণের দুর্ধর্ষ সেনাপতি লীকে পরাজিত করে একের পর এক শহর দখল করে নিলেন। লী পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন রীচমন্ড শহরে।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ চলেছিল দীর্ঘ পাঁচ বছর। যুদ্ধ শেষ হলে লী আত্মসম্পণ করেন।
লিঙ্কন সেনাবাহিনীর সঙ্গে রীচমন্ডে এসেছিলেন। এখানে নিগ্রোদের সমাবেশে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আমরা দুঃখী বন্ধুরা, তোমরা সকলে মুক্ত, বাতাসের মত মুক্ত। দাস’ এই নাম তোমাদের আর কখনো নিতে হবে না। স্বাধীনতা তোমাদের জন্মগত অধিকার।”
ওয়াশিংটনে ফিরে এলে শত শত মানুষ তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সংবর্ধিত করল।
মানুষকে মানুষের জন্মগত অধিকার ফিরিয়ে দেবার দীর্ঘ দশ বছরের সংগ্রাম এভাবেই সম্পূর্ণ করে অবশেষে এক দক্ষিণী গুপ্তঘাতকের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দেন মানবতার অবিসংবাদিত পূজারী আব্রাহাম লিঙ্কন।
৯৭. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১)
দুশো বছর আগেকার কথা। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল একটি আস্তাবল। এমনি একটি আস্তাবলের পরিচালক ছিলেন টমাস কিটস্। নিচে আস্তাবল, উপরে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন টমাস। স্ত্রী আস্তাবলের মালিকের মেয়ে। কাজের প্রয়োজনে টমাসকে যেতে হত মালিকের বাড়িতে। সেখানেই দুজনের দেখা, তারপর প্রেম, একদিন বিবাহ।