রাতে বাড়ি ফিরে বসতেন নিজের বইপত্তর নিয়ে। সমস্ত রকম ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত পড়াশুনার কাজে তার কখনো বিঘ্ন ঘটত না।
প্রথম বারে ব্যর্থ হলেও ১৮৩৪ খ্রি: নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে লিঙ্কন জয় লাভ করলেন। এবারে নির্বাচন পতিনিধি হিসাবে তাঁকে আসতে হল ইলিনয়ে। পরিষদের কাজের অবসরে তিনি লাইব্রেরী থেকে বই এনে পড়াশুনা করতে লাগলেন। এই সময়েই আইন পরীক্ষা পাশ করে আইন ব্যবসা করার সঙ্কল্প তাঁর মনে জাগে।
ইতিমধ্যে ইলিনয়ে প্রদেশের রাজধানী স্থানান্তরিত হল স্প্রিংফিল্ডে। ফলে পরিষদ সদস্য হিসাবে কাজকর্মের প্রয়োজনে লিঙ্কনকেও যেতে হল সেখানে।
আইন বিষয়ে পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিলেন লিঙ্কন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৩৬ খ্রি: আইন ব্যবসায় আরম্ভ করলেন। অসাধারণ মেধা ও কর্মকুশলতার গুণে আইনজীবী হিসেবে অল্পসময়ের মধ্যেই খ্যাতি অর্জন করলেন লিঙ্কন। তাঁর বলিষ্ঠ যুক্তি ও জ্ঞানের কাছে প্রতিপক্ষকে সহজেই হার স্বীকার করতে হত। লিঙ্কন স্বভাবতই ছিলেন ন্যায়ের পক্ষপাতী। কোন অবস্থাতেই তিনি অন্যায়কে মেনে নিতেন না। সেই কারণে কোন মিথ্যা মামলা হাতে এলে সঙ্গে সঙ্গে তা ফিরিয়ে দিতেন।
আইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠালাভের সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্কন রাজনীতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়লেন। ১৮৩৮, ১৮৪০ খ্রি: দুবার তিনি ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হলেন।
ব্যবস্থাপক সভার এক সদস্য ছিলেন স্টিফেন ডগলাস। ভাগ্যচক্রে এক নারীকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে এসময়ে লিঙ্কনের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার পরিণতি গড়িয়েছিল উত্তরকাল পর্যন্ত, ডগলাস হয়ে উঠেছিলেন লিঙ্কনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
এক সুন্দরী তরুণী, তাঁর নাম মেরি টড, তার দিদিমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। চটপটে স্বভাব ও আকর্ষণীয় কথাবার্তা শুনে যুবকরা তাঁর প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ল।
একদিন এক নাচের আসরে গেছেন লিঙ্কন আর ডগলাস। মেরিও উপস্থিত ছিলেন সেই আসরে। ডগলাসের আভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহার ও ধোপদুরস্ত পোশাক সত্ত্বেও রুক্ষ ঢ্যাঙা চেহারার ঢিলেঢালা পোশাকের লিঙ্কনের প্রতিই আকৃষ্ট হলেন মেরি।
আলাপ পরিচয় কিছুটা গম্ভীর হলে লিঙ্কন বিবাহের প্রস্তাব দেন। প্রথমে অমত করলেও শেষ পর্যন্ত ১৮৪২ খ্রি: লিঙ্কনকেই মেরি বিবাহ করলেন। বলাবাহুল্য, লিঙ্কনের বন্ধুও সহকর্মীদের মধ্যে একমাত্র ডগলাস এই বিয়েতে খুশি হতে পারেন নি।
বিয়ের পর লিঙ্কন উইলিয়ম হানডন নামে এক তরুণ আইনজীবীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আইন ব্যবসা শুরু করলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁদের এই সম্পর্ক বজায় ছিল আমৃত্যু। পরবর্তীকালে হানডন লিঙ্কনের জীবনী রচনা করেন।
স্ত্রী মেরীর তাগিদে একসময় স্প্রিংফিল্ডের আইন ব্যবসায় ছেড়ে লিঙ্কন ওয়াশিংটনে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস আরম্ভ করলেন।
মেরীর প্রবল ইচ্ছা লিঙ্কন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন। সেই মত লিঙ্কন পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করলেন এবং অল্পসময়ের মধ্যেই অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন।
দলীয় মনোনয়ন পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে যথাসময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লিঙ্কন ১৮৪৭ খ্রি: ওয়াশিংটন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলেন।
কিশোর বয়সে নিউ অর্লিয়েন্সের বন্দরে দেখা দাস ব্যবসায়ীদের বাজারের দৃশ্য লিঙ্কনের মনে জাগরুক ছিল। সংসদ সদস্য হবার পর প্রথমেই তাঁর দৃষ্টি পড়ল অনুরূপ একটি দৃশ্যের প্রতি।
ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ হোয়াইট হাউসের পাশেই গড়ে উঠেছিল নিগ্রোদাসদের একটি খোয়াড়। বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা নিগ্রোদের এই খোয়াড় থেকেই দক্ষিণের বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো হত।
আমেরিকায় দাস ব্যবসা শুরু হয়েছিল যোড়শ শতাব্দীতে কয়েকজন ওলন্দাজ বণিকের মাধ্যমে। তারা আফ্রিকা থেকে কুড়িজন নিগ্রোকে ধরে এনে জেমস টাউনে বিক্রি করে।
আমেরিকায় তখন সবে উপনিবেশ গড়ে উঠতে শুরু করেছে। বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিকের প্রচণ্ড চাহিদা। এই সুযোগকে কাজ লাগাল ইউরোপের একদল অর্থলোলুপ ব্যবসায়ী। তারা আফ্রিকা থেকে দলে দলে নারী পুরুষ ধরে এনে আমেরিকায় বিক্রি করতে আরম্ভ করল। লাভের লোভে এই ভাবেই এক সময় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল নিগ্রো ক্রীতদাসের ব্যবসা। আমেরিকার সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চল জুড়েই ছিল নিগ্রো ক্রীতদাসের চাহিদা।
লিঙ্কন যেই সময়ে ওয়াশিংটন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলেন সেই সময় পর্যন্ত আমেরিকায় নিগ্রো ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল কুড়ি লক্ষের কাছাকাছি।
স্বাধীনতা ঘোষণার পরে দাস ব্যবসায়ের বিরুদ্ধে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে জনমত গড়ে উঠেছিল। ১৮০৮ খ্রি: ক্রীতদাস ব্যবসা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও দাস ব্যবসা টিকে ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপকভাবে তুলো উৎপাদন হত। ইংলন্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে যখন নতুন নতুন কাপড়ের কল তৈরি হতে লাগল, আমেরিকার তুলো রপ্তানি বেড়ে গেল। ফলে তুলো উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দক্ষিণাঞ্চলে শ্রমিকের প্রয়োজন আগের তুলনায় বেড়ে গেল। অর্থনৈতিক সুবিধার জন্যই স্বাধীনতা লাভের সময় থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ লোক ছিল ক্রীতদাস প্রথার প্রবল সমর্থক।