লিঙ্কনের যখন মাত্র চার বছর বয়স, সেই সময় তাঁর বাবা ইন্ডিয়ানা প্রদেশের অরণ্যময় অঞ্চলে এসে সপরিবারে বাস করতে থাকেন। এখানেই জনবিরল পরিবেশে প্রকৃতির কোলে লিঙ্কনের শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়।
অরণ্যের একপ্রান্তে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ঘর বানিয়েছিলেন লিঙ্কনের বাবা। কাঠের কাজ আর শিকার করে কোন প্রকারে সংসার চালাতেন। বাবার সঙ্গে কাজ করে লিঙ্কনও ছেলেবেলা থেকেই হয়ে উঠেছিলেন পরিশ্রমী। কাঠ চেরাই, মাছ ধরা ও চাষের কাজে তিনি বাবাকে সমানভাবে সাহায্য করতেন।
ছয় বছর বয়সে লিঙ্কন মাতৃহারা হন। তারপর থেকে তিনি আর ছোট বোন মিলে বাড়ির কাজকর্ম করতেন।
লিঙ্কনের বাবার পূর্বপরিচিত এক মহিলা তিনটি শিশু সন্তান নিয়ে অকালে বিধবা হয়েছিলেন। সংসারে একজন মহিলার প্রয়োজন বিবেচনা করে তিনি সেই মহিলাকেই বিয়ে করে সংসারে নিয়ে এলেন। হাসিখুশি স্বাস্থ্যবতী এই মহিলা ছিলেন যেমন পরিশ্রণী তেমনিই বুদ্ধিমতী। অল্পদিনেই তিনি সংসারের চেহারা ফিরিয়ে নিলেন।
লিঙ্কনের বাবা নিজে লেখাপড়া জানতেন না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারেও তাই তার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তার সৎ মায়ের উৎসাহ ছিল এই বিষয়ে। সেই অঞ্চলের কিছু শিক্ষিত লোকের চেষ্টায় একটা প্রাথমিক স্কুল খোলা হয়েছিল। সম্মায়ের আগ্রহে লিঙ্কন সেই স্কুলে ভর্তি হলেন।
মাত্র একবছর এই স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিলেন লিঙ্কন। তার মধ্যেই পড়াশুনার প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে। শহরের দোকান থেকে লোকজনদের ধরে বই কিনিয়ে আনতেন তিনি। মাঠে কাজ করতে করতে সেই বই পড়তেন। রাতে কাঠের আগুনের আলোয় বসে শ্লেটে অঙ্ক কষতেন। কিশোর বয়সে তার প্রিয় বই ছিল বাইবেল ঘুরে ফিরে অসংখ্যবার তিনি এই পবিত্রগ্রন্থ পাঠ করেছেন।
তাঁর জীবনে বাইবেলের প্রভাব ছিল অতীব গভীর। উত্তরকালে তাঁর লেখায় ও বক্তৃতার মধ্যেও এই প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত নিজেদের গ্রামের আশপাশের অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও যান নি লিঙ্কন। এই সময়ে এক ব্যবসায়ীর অধীনে কাজ নিয়ে কিছু পণ্য বিক্রয় করবার জন্য নিউ অর্লিয়েন্স বন্দরে যেতে হয়। একটি বড় নৌকায় চেপে বন্দরে পৌঁছে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন লিঙ্কন।
এক জায়গায় নিগ্রো শিশু নারী পুরুষদের দাস হিসেব বিক্রি করা হচ্ছিল। নিলাম ডেকে যে সব চেয়ে বেশি দাম দিতে পারছিল তার হাতেই তুলে দেওয়া হচ্ছিল দাসদের।
যারা যেতে রাজি হচ্ছে না কিংবা কিছু মাত্র অবাধ্যতা করছে তাদের নির্মমভাবে চাবুক মেরে শায়েস্তা করা হচ্ছিল।
এই অমানবিক দৃশ্য আর দাস-ব্যবস্থার রীতি জীবনে প্রথম দেখতে পেলেন লিঙ্কন। বেদনায় তার মন ভরে উঠল। তিনি সেদিন এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন যে মনে মনে শপথ নিয়েছিলেন, যদি কোনদিন সুযোগ পান তাহলে এই জঘন্য প্রথার উচ্ছেদের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবেন।
সেবার নিউ অর্লিয়েন্সে পণ্য বিক্রয় করে প্রচুর লাভ করেছিলেন লিঙ্কন। পণ্যের মালিক ব্যবসায়ী খুশি হয়ে লিঙ্কনকে তাঁর নিউ সালেমের গুদামের ম্যানেজারের পদে চাকরিতে নিয়োগ করলেন।
কর্মজীবনে প্রবেশ করে অবসর সময়টুকু লিঙ্কন কাজে লাগালেন নানা বিষয়ের বইপত্র পড়াশুনা করে। মধুর ব্যবহারের জন্য এখানে সকলেরই প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই সুবাদে প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় নির্বাচন কেন্দ্রে কাজকর্ম দেখাশুনার দায়িত্ব পান।
নিজের অজ্ঞাতেই এভাবে রাজনীতির জগতের সঙ্গে লিঙ্কনের পরিচয়ের সুযোগ ঘটে। ক্রমে তিনি রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
সেইকালে নিউসালেমে মুষ্টিমেয় লেখাপড়া জানা মানুষের মধ্যে লিঙ্কন ছিলেন অন্যতম। মধুর ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, স্পষ্টবাদিতা এবং সহযোগিতামূলক আচরণের জন্য তিনি এখানেও অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
নিউসালেমে এক সরাইখানার মালিক হলেন জেমস রুটলেজ। লিঙ্কনের তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় সমর্থক। স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য তিনিই লিঙ্কনকে প্রথম উৎসাহিত করেন।
সরাইখানায় যাতায়াতের সূত্রে জেমসের মেয়ে অ্যানির প্রতি আকৃষ্ট হন লিঙ্কন। প্রথম পরিচয়েই তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে যখন জানতে পারেন অ্যানি এক যুবকের বাগদত্তা,তখন জীবনে প্রথম নারীর সংস্পর্শে এসে আঘাত পেয়েছিলেন লিঙ্কন। তবে অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি সে আঘাত সামলে উঠেছিলেন।
যে ব্যবসায়ীর অধীনে লিঙ্কন কাজ করতেন, তার ব্যবসা পড়ে এসেছিল। লিঙ্কন চাকরি ছেড়ে দিয়ে একজন সঙ্গীর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করলেন। সঙ্গীটির ছিল মদের নেশা। কাজেই অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসা উঠে গেল।
এই সময় কয়েকজন অনুরাগী বন্ধুর উৎসাহে ইলিয়া প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন লিঙ্কন। কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়।
নির্বাচনের ব্যর্থতার পর লিঙ্কন নিউসালেমে বাড়ি বাড়ি চিঠিপত্র খবরের কাগজ বিলি করার পিওনের চাকরি নিলেন। এই সুযোগটাকে ভালভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি এবং এবাবেই বৃহত্তর জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল।
মালিকের বাড়ি পৌঁছে দেবার আগে তিনি কোথাও বসে খবরে কাগজগুলো খুঁটিয়ে পড়ে নিতেন। দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাজের মধ্যে এইভাবে কেটে যেতো তার।