ইতিমধ্যে কাজানে শুরু হল তরুণ জনদরদী নেতা লেনিনের নেতৃত্বে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। সেই সময় গোর্কির সঙ্গীরা তাঁকে জানালেন এই আন্দোলনকারী ছাত্রদের কঠোর হাতে দমন করা উচিত।
গোর্কি এই কথা শুনে মর্মাহত হলেন।তিনি বুঝতে পারলেন, এতদিন দুঃখ মোচনের যে বিশ্বাসের কথা তিনি সঙ্গীদের বুঝিয়ে এসেছেন তা কারো মর্মস্পর্শ করেনি। তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। তার আন্তরিক বিশ্বাসের কথা কারোর মধ্যেই সঞ্চারিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তিনি একদিন স্থির করলেন গুলি করে আত্মহত্যা করবেন।
একা চলে গেলেন কাজানকা নদীর পাড়ে। বন্দুকের নল নিজের বুকে তাক করে ট্রিগার টিপে দিলেন।
প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল কাজানকা নদীর বিজন তীরভূমি। গুলিবিদ্ধ গোর্কি কাত হয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।
সেদিন নেহাতই ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়েছিলেন গোর্কি। বন্দুকের গুলি ফুসফুস ভেদ করে হৃদপিন্ডের পাশঘেঁষে চলে গিয়েছিল। তাতেই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
গোর্কির সঙ্গীরাই তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের উদ্বেগ আর আন্তরিকতার অভাব ছিল না তার জন্য। গোর্কি সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষ আসলে মানুষই থাকে, পরিবেশই তাকে অমানুষ করে তোলে।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে গোর্কিজীবনকে আরও গভীরভাবে বুঝবার দেখবার প্রেরণা বোধ করলেন। জীবনের জন্য নিরন্তর সংগ্রামের মুখোমুখি হবার লক্ষে নিজেকে তৈরি করে নিলেন।
কাজান ছেড়ে যেদিন ভবঘুরের জীবন অবলম্বন করে বেরিয়ে পড়লেন তখন তাঁর বয়স একুশ বছর। ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলেন দক্ষিণ রাশিয়ায়।
সময়টা ১৮৯১-৯২ খ্রি:। রাশিয়ায় দেখা দিল আকাল। লক্ষ লক্ষ বুভুক্ষু মানুষ গ্রামের বাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে পথে। গোর্কি নেমে পড়লেন ত্রাণের কাজে।
সেই সময় একই কাজে হাত লাগিয়েছেন লিও তলস্তয়, চেখভসহ অন্যান্য তরুণ লেখকরা। অনুপ্রেরিত হলেন গোর্কি। শ্রমিক জীবনের পাশাপাশি হাতে তুলে নিলেন কলম, মন থেকে ঝেড়ে ফেললেন হতাশা। সংকল্প নিলেন মাথা তুলে দাঁড়াবার।
ছিলেন আলেক্সেই পেশকভ, এবারে ছদ্মনাম নিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। ভল্লা নদীর তীরবর্তী মফস্বল শহরের কাগজে ছাপা হতে লাগল তাঁর লেখা।
অল্পদিনের মধ্যেই গোর্কি লেখা প্রতিষ্ঠিত লেখক ও প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের নজরে এলো।
১৮৯৫ খ্রি: প্রথম সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি জনপ্রিয় কাগজে গোর্কির ‘চেলকাস’ প্রকাশিত হল। এটিই বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প যার উপজীব্য একজন বন্দুক চোরের কাহিনী। রূঢ় বাস্তব আর রোমান্টিকতার মিশ্রণে এ এক অপূর্ব সৃষ্টি।
গল্পটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই গোর্কি লাভ করলেন অসাধারণ জনপ্রিয়তা। এরপর রুটির কারখানার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গোর্কি লিখলেন টুয়েন্টি সিকস মেন অ্যান্ড গার্ল গল্পটি।
এই গল্প তাঁকে এনে দিল সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তিনি চিহ্নিত হলেন চেখভ এবং তলস্তয়ের সমকক্ষ রূপে।
এরপর সাহিত্য রচনাতেই পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন গোর্কি। লিখে চললেন, গল্প, উপন্যাস, নাটক।
একটু একটু করে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ১৮৯৮ খ্রি: প্রকাশিত হল ভার গল্প সংগ্রহ।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ফোমা গার্দেয়েভ প্রকাশিত হয় ১৮৯৯ খ্রি:। একই সময়ে প্রকাশিত হয় তলস্তয়ের রেজারেকশান। কিন্তু তলস্তয়ের রচনার জনপ্রিয়তা স্নান করতে পারেনি ফোমা গার্দেয়েভকে। এই সময়েই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় চেকভের।
১৯০৫ খ্রি: রাশিয়ার বিপ্লবের সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন গোর্কি। এর কিছুদিন পরেই লন্ডনে লেনিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার ঘটে। রাশিয়ায় ফিরে আসেন প্রথম মহাযুদ্ধের পরে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিচিত্র কাজের মধ্য দিয়ে গোর্কির পরিচয় ঘটেছিল নানাশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে। এদের মধ্যে ছিল চোর, জুয়াড়ি, খুনে, মাতাল, বেশ্যা ইত্যাদি।
সবশেষে সান্নিধ্যে আসেন বিপ্লবী তরুণ দলের। এইভাবে লাভ করা ব্যাপক অভিজ্ঞতাই গোর্কি ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর অজস্র গল্প-উপন্যাস-স্মৃতিচিক্র আত্মজীবনীর পৃষ্ঠায়।
১৯০৭ খ্রি: তাঁর সাহিত্য জীবনের শ্রেষ্ঠকীর্তি Mother প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য রচনা হল : লোয়ার ডেপথস, পেটিবুর্জোয়া, ফোমাগোরদিয়েভ, ক্লিম সামঘিন ইত্যাদি। গোর্কির মাদার উপন্যাস রাশিয়ার ৫৪টি ভাষায় ও বিদেশে ৪৪টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাঁর সুবিখ্যাত আত্মজীবনীর নাম চাইল্ডহুড, ইন দি ওয়ার্ল্ড, মাই ইউনিভার্সিটিস। প্রাক-বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর কালে সোভিয়েত রাশিয়ার সাহিত্যে গোর্কি স্মরণীয় স্রষ্টা। মানবচেতনা প্রসারের তাঁর দান শুধু রাশিয়ার সীমাবদ্ধ নয়। তা সারা পৃথিবীতে নন্দিত। কেবল আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক রূপে নয়, মানুষ হিসেবেও তাঁর উদারতা ও হৃদয়ের প্রসারতা ছিল অপরিসীম। এই কারণে তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
৯৬. আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫)
পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়জন মানবতাবাদী গণতন্ত্রপ্রেমী মহান রাষ্ট্রনায়ক জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে বিশিষ্টতম হলেন আব্রাহাম লিঙ্কন।
আমেরিকার কেন্টাকি প্রদেশের অখ্যাত এক গ্রামের ছুতোর পরিবারে ১৮০৯ খ্রি: জন্ম হয় লিঙ্কনের। তাঁর পিতা টমাস লিঙ্কন ছিলেন পেশায় ছুতোর মিস্ত্রী। লেখাপড়া তিনি কিছুই জানতেন না। হাতের কাজ করে কোন রকমে সংসার প্রতিপালন করতেন।