চার্লি সরাসরি তার অভিযোগগুলো প্রকাশ করলেন। অভিনয়ে তার কোন স্বাধীনতা ছিল না। এ ছাড়া সাজপোশাকও করতে হয়েছিল নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
এরপর চার্লি প্রস্তাব করলেন, তাঁর মত করে অভিনয় করতে দিতে হবে। আর সাজপোশাকও নিজেই ঠিক করবেন।
শিল্পীর স্বাধীনতা মেনে নিলেন ম্যাক সেনেট। জানালেন, দ্বিতীয় ছবিতে তাঁকে অভিনয় করতে হবে এক সাংবাদিকের ভূমিকায়। সম্পূর্ণ হাসির রোল।
এবারে চার্লি নিজেই পড়লেন মুশকিলে। পোশাকের ব্যাপারটা নিয়ে আগে বিশেষ কিছু ভেবে রাখেননি তিনি। অথচ তার ইচ্ছা এমন কিছু একটা করা, যা আগে কেউ কখনো করেনি। আবার তা হবে এমন, যা দেখেই দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়তে বাধ্য হবে। চিন্তায় ডুবে গেলেন চার্লি পোশাকটা কেমন হওয়া দরকার কেবল তাই নিয়ে। পোশাকটাই হবে অভিনীত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।
চার্লি যে ঘরে থাকতেন, তার পাশের ঘরেই থাকতেন দশাসই চেহারার এক অভিনেতা। তাকে লক্ষ্য করে হঠাৎই একদিন তার মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল।
চার্লির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দৈহিক মাপের সেই অভিনেতার ঢোলাঢালা ট্রাউজারটা পরে নিলেন। কিন্তু গায়ে চাপালেন নিজেরই ছোট হয়ে যাওয়া একটা জ্যাকেট।
মাথায় পরলেন বাউলার টুপি। লম্বা টাই ঝোলালেন গলায়। প্রতিবেশী অভিনেতার। বিরাট আকারের জুতো দিয়ে পা ঢাকলেন, তবে উল্টোভাবে। এরপর হাতে নিলেন ছোট্ট
ছড়ি, ঠোঁটের ওপরে সঁটলেন খাটো গোফ।
সাজটা উদ্ভট-বিকুটে রকমের হলেও চার্লির বেশ মনের মতই হল। তবে সেদিন তিনি নিশ্চয় কল্পনাও করতে পারেননি যে এই বিচিত্র উদ্ভট সাজেই একদিন জগৎজোড়া খ্যাতির অধিকারী হবেন।
পোশাক অনুমোদন করার পর চার্লি পাকাপাকিভাবে ঠিক করে নিলেন, এই বিচিত্র · পোশাকের সঙ্গে তাঁর অভিনয়টাও হবে অদ্ভুত করমের।
শিল্পী হিসেবে তাঁর যা বক্তব্য তা তিনি প্রকাশ করবেন এই পোশাক ও অভিনয়ের মোড়কেই। এরপর পোশাক ও অভিনয় ভঙ্গিতে এক নতুন চার্লির আবির্ভাব ঘটল পর্দায়। যাত্রা শুরু হল চার্লি চ্যাপলিনের। এরপরে কেবল অর্থ, খ্যাতি, যশ, সম্মান–এরই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল শিল্পী চার্লির জীবন।
স্বাধীনভাবে ছবি তৈরি করার উদ্দেশ্যে চার্লি কিছুদিন পরে দুই ধনী ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় গঠন করলেন ইউনাইটেড আর্টিস্ট ফিলাস। ১৯১৭ খ্রি: চার্লির সোলডার আর্মস ছবি চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা লাভ করল। ছবির সুবাদে অর্থাগম হতে থাকে স্রোতের মত।
১৯১৮ খ্রি: তিনি বিয়ে করলেন সুন্দরী তরুণী মিলড্রেড হ্যারিসকে। কিন্তু এই বিয়ে শান্তির হল না। অল্পদিন পরেই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেল।
এরই মধ্যে একে একে মুক্তি পেতে লাগল চার্লির দুনিয়া কাঁপানো সব ছবি। দি কিড, দি পিলগ্রিম, এ উওম্যান অব প্যারিস, দি গোল্ডরাশ, দি সার্কাস, দি সিটি লাইট ইত্যাদি।
শেষোক্ত ছবিতে চার্লির প্রতিভার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ছবি তার এক অনন্যসাধারণ অবদান।
চার্লি আগাগোড়া সেই ঢলঢলে ট্রাউজার, পায়ে বেঢপ মাপের জুতো, গায়ে আঁটোসাটো জামা, মাথায় বাউলার টুপি ইত্যাদি নিয়ে সব ছবিতে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছেন।
হলিউডে নিজস্ব বাড়ি তৈরি হলে চার্লি সেখানে তাঁর চিরদুঃখিনী মাকে নিয়ে এসেছিলেন। জীবনের অবশিষ্ট কাল তিনি এখানেই মাতৃভক্ত পুত্রের সেবাযত্নে সুখে। অতিবাহিত করেছেন।
১৯৩১ খ্রি: হলিউডে নির্বাক ছবির যুগে শেষ হলে নরদানব হিটলারকে নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে নির্মিত হল চার্লির দি গ্রেট ডিকটেটর ছবি। এই ছবিতে তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আর কৌতুকের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুললেন হিটলারের চরিত্র। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চার্লির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল,তিনি কমিউনিজম প্রচার করছেন।
চার্লির ছবির বিশেষত্ব হল, মানুষের জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, সুখ, ব্যথা-বেদনা, অনুভূতির বাঙ্গময় প্রকাশ। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, প্রগাঢ় ভালবাসা, অন্যায়ের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও মানবিক চেতনা তাঁর প্রতিটি ছবির মূল প্রতিপাদ্য।
সঁসিয়ে ভার্দু, লাইম লাইট, এ কিং অব নিউইয়র্ক চার্লির অসামান্য ছবিগুলোর অন্যতম।
১৯১৪ খ্রি: থেকে ১৯৩৯ খ্রি: পর্যন্ত তৈরি হয়েছে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সব ছবি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের একচ্ছত্র অধিপতি। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তাকে আপনজন বলে মেনে নিয়েছে। দেশে দেশে তিনি লাভ করেছেন রাজকীয় সম্বর্ধনা।
চার্লির চতুর্থ স্ত্রীর নাম উনা। ইনি ছিলেন আমেরিকান নাট্যকার ইউজিন ও-নীলের কন্যা। চুয়ান্ন বছর বয়সে আঠারো বছরের উনাকে বিয়ে করেছিলেন চার্লি এবং তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল সুখ শান্তিতে পরিপূর্ণ।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চার্লি। তাঁর জীবন ছিল অনন্য নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও মানব প্রেমের প্রতিভূস্বরূপ। আত্মজীবনীতে তাঁর জীবনবোধ ও আদর্শ অকপটভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি।
১৯৭৭ খ্রি: ২৫শে ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডের বাসভবনে বিশ্বমানবতার পূজারী ও রুপোলী পর্দার অনন্য নায়ক চার্লি চ্যাপলিনের জীবনাবসান হয়।
৯৪. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০)
বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক চার্লসডিকেন্স নামেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি। ১৮১২ খ্রি: ৭ ফেব্রুয়ারী পোর্টসমাউথের ল্যান্ডপোর্টে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জন ডিকেন্স নৌ-বিভাগের সামান্য কেরানীর কাজ করতেন। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ বা ডিকেন্স পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে।