প্রথম রাতে অভিনয় করেই হল মাতিয়ে দিলেন চার্লি। দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন চার্লি।
সুনামের সঙ্গে টানা দুই বছর এই দলে অভিনয় করলেন তিনি। এখানেই তাঁর পরিচয় হল অভিনেত্রী হেটি কেটীর সঙ্গে।
প্রথম আলাপেই দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সেই প্রথম প্রেম চার্লির জীবনে। কিছুদিন মেলামেশার পর চার্লি বিয়ে করতে চাইলেন কেটীকে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ালেন কেটীর মা।
দুজনের মিলন আর সম্ভব হল না। জীবনের প্রথম প্রেমই এভাবে ব্যর্থ হল। অনেক দিন এই ব্যর্থতার বেদনা চার্লিকে পীড়া দিয়েছিল। জীবনে কেটীর সঙ্গে আর কোনদিন
দেখা হয়নি। কিন্তু তার স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছেন সারা জীবন।
চার্লির জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা ১৯০৯ খ্রি:। নাটকের দলের সঙ্গে প্যারিসে গেলেন। এখানকার মানুষের খোলামেলা উজ্জ্বল জীবন মুগ্ধ করল তাঁকে। পাশাপশি নিজের জীবন, জীবনযাত্রাকে খুবই অকিঞ্চিতকর মনে হল তার। যেন তিনি অদৃশ্য কোন গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন। কিছুতেই বাইরে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ ক্রমাগত হাতছানি তাকে টানছে যেন অনুভব করছেন।
ইংলন্ডে ফিরে এসে আবার সেই ভ্রাম্যমাণ জীবনের একঘেয়েমির সঙ্গে যুক্ত হলেন।কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন ক্রমশই ভিতরে ভিতরে। ভাঁড়ামো, রঙ্গ-তামাশা এসব যেন হঠাৎ কেমন কাটার মত বিঁধতে লাগল। অথচ এটাই তার নাটকের জীবনে বাঁধাধরা গন্ডি।
এই সময় অপ্রত্যাশিত ভাবেই চার্লির জীবনে পরিবর্তনের সুযোগ এসে গেল। আমেরিকায় দলের একটা নতুন শাখা খোলার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে একজন কৌতুকাভিনেতার প্রয়োজন পড়েছিল।
কারোনার দলের মালিক ফ্রেডকারননা আমেরিকা যাবার প্রস্তাব দিতেই একরকম লুফে নিলেন চার্লি। নতুন কিছু করার জন্য ভিতরে ভিতরে তিনি প্রবল অস্থিরতা বোধ করছিলেন। ইংলন্ডে তা করবার সুযোগ ছিল না। কেননা এখানকার দর্শকরা তাঁর রঙ্গ কৌতুকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। নতুন কিছু ওরা সহজে মেনে নিতে চাইবে না।
চার্লি ইংলন্ড ছেড়ে আমেরিকায় চলে এলেন ১৯১০ খ্রি:। প্রথম অভিনয় করলেন ৩রা অক্টোবর নিউইয়র্কের কলোনিয়াল থিয়েটারে। নাটকের নাম অউ-হাউস।
নিউইয়র্কের দর্শকদের মন জয় করে নিলেন প্রথম অভিনয়ের রাতেই। পত্রপত্রিকাতেও তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রকাশিত হল। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন চার্লি।
এরপর যেখাইে দলের সঙ্গে গেছেন সেখানেই তাঁর কৌতুকাভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ, আপুত করেছে।
চার্লির জীবনে এভাবেই ধীরে ধীরে সৌভাগ্যের সূত্রপাত হতে লাগল।
একদিন নাটক দেখতে এসেছিলেন এক সিনেমা কোম্পানির কর্মকর্তা অ্যাডাম কেসেল। চার্লির অভিনয় দেখে তিনি এমন মুগ্ধ হলেন যে নাটক শেষ হলে নিজে গিয়ে
তার সঙ্গে আলাপ করলেন। সাগ্রহে প্রস্তাব দিলেন সিনেমায় অভিনয় করবার।
ততদিনে শিল্পী চার্লির স্বকীয় চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে। তিনি কি করতে চান, কিভাবে তা করবেন- এসব বিষয়ে পরিষ্কার একটা ছক নিজের মনে তৈরি করে নিয়েছেন।
সেই সময় সিনেমা সবে হাঁটতে শিখেছে। নির্বাক যুগ। অভিনেতাদের মুখে সংলাপ থাকে না। পরিবেশ পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য অভিনয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে বাজনা বাজানো হয়।
আমেরিকায় আসার পর এরকম দু-একটা সিনেমা দেখেছিলেন চার্লি। কিন্তু তাঁর মোটেই ভাল লাগেনি। অভিনয়কে মনে হয়েছে নিতান্তই কৃত্রিম। আর বাজনা তো একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।
এই ধারার সঙ্গে নিজেকে জড়াবার মত মানসিক সাড়া পেলেন না চার্লি। যদিও সপ্তাহে ষোল ডলার মাইনেটা ছিল রীতিমত লোভনীয়। তবুও তিনি সিনেমার অভিনয়ের প্রথম সুযোগ সুবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন।
কেসেল ছিলেন পাকা জহুরী। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তাঁর। চার্লি সহজাত প্রতিভা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও চার্লিকে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেন।
আমেরিকায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে সেবারের মত চার্লিকে ইংলন্ডে ফিরে আসতে হল। ফেরে এলেন দু বছর পরে।
এবারে মন স্থির করেই এসেছিলেন। প্রথমেই দেখা করলেন কেসেলের সঙ্গে। জানালেন থিয়েটারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই তার কোম্পানিতে যোগ দেবেন।
কিছুদিন পরেই নাটকের সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন চার্লি, যোগ দিলেন সিনেমায়। মাইনে স্থির হল সপ্তাহে পঁচিশ ডলার। নাটক দিয়ে অভিনয় জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল এভাবেই তার ছায়াছবির পর্দায় পদার্পণ ঘটল।
তখনো হলিউড সাধারণ পর্যায়ে। সাদামাটা কিছু যন্ত্রপাতি ও ছবির সেট ছাড়া সেখানে আর কিছু ছিল না।
কেসেলের সঙ্গে হলিউডে এসে চার্লির মন দমে গেল। এখানকার কাজের পরিবেশ, মানুষজন দেখে কাজের উৎসাহ ঝিমিয়ে গেল তার। তবু প্রথম একটা ছবিতে অভিনয় করলেন। নিতান্তই যেন দায়সারা ভাবে।
থিয়েটারের সেই প্রণোচ্ছল টগবগে চার্লি যেন কেমন নিস্তেজ, প্রাণহীনভাবে হাতমুখ নেড়ে গেলেন কেবল। অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততার স্পর্শ তার মধ্যে ছিল না।
কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে গেলেন চার্লির অবস্থা দেখে। কোম্পানির মালিক ম্যাক সেনেট তো রীতিমত নিরাশ হলেন এবং তা প্রকাশ করতেও ইতস্ততঃ করলেন না।