লন্ডনের ইস্ট লেনের এক দরিদ্র শিল্পী পরিবারে ১৮৮৯ খ্রি: ১৬ই এপ্রিল জন্ম হয়েছিল চার্লির। তাঁর বাবা অভিনয় করতেন থিয়েটারে, মা ছিলেন গায়িকা।
বাবা যা রোজগার করতেন মদের পিছনেই তা ফুকে দিতেন। ফলে অভাবের সংসারে বাসা বেঁধেছিল নিত্য অশান্তি।
চার্লির যখন এক বছর বয়স, আর তাঁর দাদা সিডনির চার বছর সেই সময় মা বাবা দুজনের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। দুঃখিনী মা দুই ছেলেকে নিয়ে উঠে এলেন আলো বাতাসহীন এক বস্তির অন্ধকার ঘরে।
থিয়েটারে গান করে মা যা রোজগার করতেন তিনটি মানুষের কায়ক্লেশে চলে যেত।
একটু বড় হয়ে মাকে সাহায্য করবার জন্য সিডনি বাচ্চাদের মধ্যে মজার মজার খেলা দেখিয়ে রোজগারের চেষ্টা করতেন। চার্লির ভারি ভাল লাগত দাদার খেলাগুলো। তিনি ভাবতেন বড় হয়ে দাদার মত খেলা দেখাবেন।
চার্লির যখন পাঁচ বছর বয়স, সেই সময় সংসারের দুঃখের অন্ধকার আরও ঘণীভূত হল। একদিন গান গাইতে গাইতে মায়ের কণ্ঠস্বর কেমন বিকৃত হয়ে গেল। সে গলা আর কোনদিন স্বাভাবিক হল না–চিরদিনের জন্য তার গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
চরম দুঃখের গ্লাসে পড়লেন তিনটি অসহায় প্রাণী। এই সময়ের দিনগুলো যেন কাটতেই চাইত না। মনে হতো এই অর্ধাহার অনাহারের গ্লানিময় জীবন বুঝি এমনিই শেষ হয়ে যাবে।
দাদা সিডনি ইতিপূর্বে জাহাজে চাকরি নিয়ে দূরে কোন দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। অসুস্থ মাকে নিয়ে একা কোন রকমে দিন গুজরান করতে লাগলেন চার্লি। এই সময় যখন যে কাজ পেয়েছেন ক্ষুধার রুটি জোগাড় করবার জন্য তাই করতে হয়েছে তাঁকে।
কখনও খবরের কাগজ ফিরি করেছেন, জুতো পালিশ করেছেন,মোট বইতেও দ্বিধা করেন নি। পুঁড়িখানার সামনে মাতালদের গান শুনিয়ে, নাচ দেখিয়ে টুপি পেতে ভিক্ষেও করেছেন। এমনি করে চরম দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে বারোবছরে পা দিলেন চার্লি। তদদিনে মা আরও নির্জীব হয়েছেন। তার বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখ, কোটরে বসা চোখ আর অনাহারে ক্লিষ্ট শরীর সহ্য করতে পারতেন না তিনি। বুকের ভিতরটা অসহ্য ব্যথায় মুচড়ে উঠত। আকুল হয়ে ভাবতেন, কবে তিনি দু’হাত ভরে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারবেন–মায়ের মলিন শীর্ণ মুখে আবার হাসি দেখতে পাবেন।
একদিন জাহাজ থেকে ফিরে এলেন সিডনি। কিন্তু সংসারে সাহায্য করবার মত সম্বল কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি। এদিকে দুঃখের জ্বালা সইতে না পেরে মায়ের মাথায় দেখা দিয়েছে গোলমাল। দুভাই মিলে অগত্যা মাকে পাঠালেন পাগলা গারদে।
আর নিরুপায় অবস্থায় তাদের উঠতে হল গিয়ে বাবার আশ্রয়ে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হল না! সম্মায়ের যাতনা ছিল অসহনীয়।
কিছুদিনের মধ্যে মা ভাল হয়ে উঠলেন। আবার তিনজনে ফিরে এলেন আগের বস্তির ঘরে। ভাগ্য এবারে বুঝি কিছুটা প্রসন্ন হল। সিডনির একটা চাকরি জুটল। যৎসামান্য মাইনে। কিন্তু সেই সামান্যই দরিদ্রের সংসারে অসামান্য।
দাদার রোজগারে যদি কিছু যোগ করা যায় এই আশায় চার্লিও কাজের সন্ধানে পথে নামলেন।
নাটক দলের আখড়া বেডফোর্ড স্ট্রিটের কাছেই ছিল বস্তিটা। প্রতিদিন সেই পথে যাতায়াতের সময় নাটক দলের অফিসগুলো চোখে পড়তো চার্লির।
অভিনয় তার রক্তের। ছোটবেলায় বাবার অভিনয়ও দেখেছেন দু-একবার। তখন থেকেই স্বপ্ন বাবার মত অভিনেতা হবার। তাই কাজের সন্ধানে নেমে নাটকের দলের কথাই আগে মনে পড়ল তাঁর। যদি কোন নাটক দলে সামান্য একটা কাজ পাওয়া যায়।
কিন্তু একের পর এক অফিস ঘরগুলোর দরজা পার হয়ে যান। ভিতরে ঢোকার সাহস করে উঠতে পারেন না।
একদিন মনে বল সঞ্চয় করলেন। তারপর কপাল ঠুকে ঢুকে পড়লেন এক নাটক দলের অফিস ঘরে। কিন্তু কাজের কথা পাড়তেই কেরানী ভদ্রলোক দরজা দেখিয়ে দিলেন।
সেদিনের মত নিরাশ হয়ে ফিললেও হাল ছাড়লেন না চার্লি। দু’চারদিন পর পরই গিয়ে হাজির হন সেই অফিসে।
ততদিনে ভয় সঙ্কোচ কেটে গেছে। কাজ একটা তার চাই যে করে হোক, কে বিরক্ত হল তা দেখলে তো চলবে না।
ভাগ্যক্রমে একদিন পড়ে গেলেন মালিকের চোখে। সপ্রতিভ চার্লিকে দেখে তার ভাল লেগে গেল। কাজও জুটে গেল।
সেই সময় শার্লক হোমস নামে একটা নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে সেই দলের। তাতে বিলি বলে একটা ছোট ছেলের ভূমিকায় যে ছেলেটি অভিনয় করতো, সে চলে যাবে বলে তার জায়গায় নেওয়া হল চার্লিকে।
মাইনে ঠিক হল সপ্তাহে ২ পাউন্ড ১০ শিলিং। টাকাটা প্রত্যাশার চাইতেও অনেক বেশি। খুশি হয়ে চার্লি ভাবলেন, এবার বুঝি সংসারের অভাব ঘুচল।
ভবিষ্যতে যার অনবদ্য অভিনয় গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে তুলবে, অভিভূত করবে,সেই অবিস্মরণীয় শিল্পীর অভিনয় জীবন এভাবেই শুরু হল।
এই সময় দলের সঙ্গে নাটক দেখাবার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে চার্লিকে। সেই ভ্রাম্যমাণ জীবন ভাল লাগতো তার।
যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যে দাদাকেও নাটুকে দলে ভিড়িয়ে নিলেন চার্লি। নিজে জায়গা করে নিলেন আরও বড় দলে। তিনি তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন- ইংলন্ডের সব সেরা অভিনেতা হবেন।
চার্লির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফ্রেডকারননা নামে এক থিয়েটার মালিক। তাঁর দলের নাম কারোনার। সেখানে ফুটবল ম্যাচ নাটকে হাসির অভিনয় করবার জন্য চার্লিকে তাঁর দলে নিয়ে এলেন। সেই সময় চার্লির সতেরো বছর বয়স।