এবারে তাঁরা স্থির করলেন, তাঁদের সাফল্যের কথা সমস্ত মানুষকে জানাতে হবে। এই উদ্দেশ্যে তারা আমেরিকার পত্রিকাগুলোকে আমন্ত্রণ জানালেন তাদের আকাশে ওড়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবার জন্য।
মানুষ পাখির মত আকাশে উড়বে অধিকাংশ পত্রিকার লোকই বিশ্বাস করতে পারল না। তবুও কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্য পত্রিকার সাংবাদিকরা নির্দিষ্ট দিনে এসে উপস্থিত হলেন।
কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই ছিল ঝড়ো বাতাস। এছাড়া নুতন ইঞ্জিনটাও ঠিকভাবে কাজ করছিল না। দুর্ভাগ্যের ফেরে রাইট ভাইদের তাদের পরিকল্পনা বাতিল করতে হল।
রাইট ভাইদের সমস্ত প্রচারই মিথ্যা এই ধারণা নিয়ে সাংবাদিকদের সকলেই ফিরে গেলেন।
বিপর্যয়টা ছিল আকস্মিক। তাই প্রথমে অপ্রস্তুত হলেও কাটিয়ে উঠতেও সময় লাগল না। রাইট ভাইরা নতুন উদ্যমে আবার কাজে নেমে পড়লেন।
ইঞ্জিনের গোলমাল সারাই করে নিজেরাই এবারে আকাশে ওড়া অভ্যাস করতে লাগলেন। প্রচারের কথা মাথায়ও আনলেন না তারা। সকলের অগোচরেই দুভাই মিলে ধীরে ধীরে আকাশে ওড়ার সময় বাড়াতে লাগলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই এক মাইলের বেশি দূরত্ব বিমান নিয়ে অতিক্রম করে গেলেন তাঁরা।
বিমান নিয়ে আকাশে ওড়ার গবেষণার কাজটি রীতিমত ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। এই কাজ করতে গিয়ে দুই ভাই এতদিনে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ফলে বাধ্য হয়েই উড়াউড়ির কাজ কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখতে হল।
অর্থোপার্জন দরকার। দুইভাই মিলে ব্যবসায়ের কাজে নেমে পড়লেন।
সময় খুব বেশি লাগল না বাজারের ধার দেনা পরিশোধ করতে। কিছু অর্থ সঞ্চয়ও হল। দুভাই মিলে আবার ফিরে এলেন নিজেদের আগের কাজে।
সেই সময় ইউরোপের কয়েকজন বিজ্ঞানী উড়ন্ত যান নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাই রাইট ভাইদের মনে আশঙ্কা ছিল, আবার কেউ না তাদের আগে তৈরি বিমান নিয়ে আকাশে উড়ে পৃথিবীকে চমকে দেয়। তাহলে তাদের সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে যাবে। বঞ্চিত হবেন আকাশযান তৈরির কৃতিত্বের গৌরবে।
অবশ্য তেমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল না। রাইট ভাইরা তাঁদের আকাশে উড়া প্রত্যক্ষ করবার জন্য এবারে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানালেন।
নির্দিষ্ট দিনে সকলেই উপস্থিত হয়ে সবিস্ময়ে দেখলেন, নিজেদের তৈরি বিমানে রাইট ভাইরা একে একে পাখির মতই স্বচ্ছন্দে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছেন।
যা ছিল এতদিন অবিশ্বাস্য অসম্ভব, এতদিনে তা সফল হল! মাটির মানুষের বিজয় অভিযান সম্প্রসারিত হল আকাশে। এই বিস্ময়কর সংবাদ বাতাসের মতই আমেরিকা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত ইউরোপে। চর্তুদিকে পড়ে গেল জয়জয়কার। আসতে লাগল শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন।
এবারে রাইট ভাইরা পরিকল্পনা নিলেন আরো উন্নত ধরনের বিমান তৈরির। দেখা দিল অর্থের সমস্যা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল সিন্ডিকেট। আমেরিকান সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি স্বাক্ষরিত হল।
শর্ত অনুসারে অরভিল আমেরিকায় থেকে উন্নত ধরনের বিমান তৈরির কাজে মনোনিবেশ করলেন।
উইলবার গেলেন ফ্রান্সে। সেখানে বিমানে চেপে আকাশে ওড়ার কলাকৌশল দেখিয়ে চমৎকৃত করলেন সকলকে।
ফ্রান্সেই প্রথম উইলবার একজন সহযাত্রী নিয়ে আকাশে একঘণ্টা বিমান চালালেন। মানুষের আকাশ জয়ের ইতিহাসে সে-ও এক ঐতিহাসিক ঘটনা।
ফ্রান্সের এক বিখ্যাত কোম্পানি উইলবারের কাছ থেকে তাঁদের আবিষ্কৃত বিমানের পেটেন্ট কিনে নিলেন বিরাট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। এতদিনে বিমানের সুবাদে রাইট ভাইদের অর্থের সমস্যাও দূর হল।
অরভিল ছিলেন আমেরিকায়। একদিন একজন সামরিক অফিসারের সঙ্গে বিমানে আকাশে ঘুরে বেড়াবার সময় দুর্ভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনায় পড়লেন তিনি। প্রপেলার ভেঙ্গে বিমানটি মাটিতে আছড়ে পড়ল। সঙ্গী অফিসারটি দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন। অরভিল আহত হলেও প্রাণে বেঁচে গেলেন। কিছুদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠলেন।
ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ উপলব্ধি করতে পেরেছে আকাশযানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনের ব্যাপকতা। সকলেই ব্যস্ত হয়ে উঠল এরোপ্লেন কেনার জন্য। তা নিয়ে শুরু হয়ে গেল দেশে দেশে পরিকল্পনা রচনা।
রাইট ভাইদের দীর্ঘ শ্ৰম অধ্যবসায় ও অনুশীলনের সাফল্যের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে এল গতির যুগ।
এই গতি ত্বরান্বিত করল সভ্যতার অগ্রগতিকে। বস্তুতঃ সামগ্রিকভাবে এই অগ্রগতি সম্ভব করে তুললেন রাইট ভাইরা দুজন।
অল্পসময়ের মধ্যেই দেশে তৈরি হল বিমান তৈরির কারখানা। নতুন নতুন বিমান তৈরি হতে লাগল পূর্ণোদ্যমে। দেশের উৎসাহী তরুণদের বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন অরভিল আর উইলবার।
১৯১২ খিঃ উইলবার মারা গেলেন। অরভিল বেঁচে ছিলেন আরও কয়েক বছর। বিমানের উন্নতি ও উৎপাদনের কাজেই তিনি আমৃত্যু নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।
৯৩. চার্লি চ্যাপলিন (১৮৮৯-১৯৭৭)
কঠোর জীবন-সংগ্রাম আর ক্লান্তিহীন অধ্যবসায়ের বলে দীনহীন ধূলার জীবন থেকে নিজেকে পরিণত করেছিলেন পৃথিবীর অন্যতম মহত্তম ব্যক্তিতে একজন মাত্র মানুষ যার হৃদয় ছিল মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা, সহমর্মিতা আর বিশ্বাসে ভরপুর, সুদীর্ঘ জীবনে যিনি বিশ্বমানবতাবোধের আদর্শকে প্রচারের মাধ্যম করেছিলেন চলচ্চিত্রকে, যিনি অন্যায়কে কোন দিন প্রশ্রয় দেননি, ভালবাসা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করেননি–তাঁর নাম চার্লস চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিন নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।