আকাশযান সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা কিছু বিজ্ঞানীরা লিখেছেন, তাঁদের ব্যর্থতা, সাফল্য ও চিন্তাভাবনার ইতিবৃত্ত নিয়ে দুই ভাই অধ্যয়ন করলেন গভীর মনোযোগ দিয়ে।
এইভাবেই তারা ধীরে ধীরে বাতাসের গতিবেগ, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তার চাপ, ভারসাম্য নির্ণয়ের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করলেন।
ইতিপূর্বে কি পদ্ধতিতে উড়ন্তযান নির্মাণ করা হয়েছে সেই কৌশলও তারা রপ্ত করে নিলেন।
সূদূর অতীতে নীল আকাশে পাখিদের ওড়া দেখে একদিন মানুষের মনেও সাধ জেগেছিল আকাশে উড়বার। কিন্তু পাখিরা আকাশে ওড়ে ডানার সাহায্যে, মানুষের তো ডানা নেই। সেই অভাব তো মানুষের পক্ষে পূর্ণ করা সম্ভব নয়। তবু, অনেক দুঃসাহসী মানুষ কৃত্রিম ডানা পিঠে বেঁধে আকাশে উড়বার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে ওড়া হল না। বাড়ল দুর্ঘটনা।
তারপর সেই চেষ্টা বন্ধ করে মানুষ বানাল বেলুন। কিন্তু বেলুনে চেপে শূন্যে ভাসা সম্ভব হলেও মানুষের আশা পূরণ হল না।
তারপর বানানো হল খেলনার আকৃতির গ্লাইডার। এই যন্ত্রগুলো নানান কৌশলে আকশে ওড়ানো সম্ভব হল বটে, কিন্তু তাতে চেপে মানুষের আকাশে ওড়ার সাধ পূর্ণ হল না।
মানুষের আকাশে ওড়ার ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাটতে রাইট ভাইয়েরা এখানে এসে থামলেন। তাঁরা স্থির করলেন, এমন যন্ত্র বানাতে হবে যা চেপে মানুষ ইচ্ছামত আকাশে উড়ে বেড়াতে পারবে।
নিজেদের কারখানায় আবার শুরু হল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। দীর্ঘ এক বছরের চেষ্টায় একটা বড় আকারের গ্লাইর বা উড়ন্ত যান তৈরি হল। গ্লাইডারের বিশেষত্ব হল এটি বাতাসে ভারসাম্য রেখে সহজেই উড়ে যেতে পারবে।
এই সাফল্যই নতুন প্রেরণার সঞ্চার করল দুই ভাইয়ের মধ্যে। এরপরই তারা তৈরি করলেন দুই পাখা বিশিষ্ট একটি ছোটখাট বিমান। ভারসাম্য রক্ষার জন্য এলিভেটর নামের একটি ছোট যন্ত্র এই বিমানের সামনে ও পিছনে জুড়ে দেয়ওয়া হল। এই যন্ত্রটি বিমানের গতি নিয়ন্ত্রণ করতেও পাইলটকে সাহায্য করবে।
সাফল্যের আনন্দ নিয়ে একদিন বিমান নির্মাণের কাজ শেষ হল। তারপর শহর থেকে দূরে খোলা এক মাঠে নিয়ে গিয়ে বিমানটিকে শূণ্যে উড়িয়ে দেওয়া হল।
এই কাজও ছিল পরীক্ষার পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় বুঝতে পারলেন, তাঁদের কলাকৌশলের কিছু পরিবর্তন দরকার।
আবার শুরু হল চিন্তাভাবনা ও সেই মত কাজ। বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেল, পেট্রল চালিত হাল্কা ইঞ্জিনই বিমানটির পক্ষে উপযোগী।
সেই সময়ে বাজারে যেসব ইঞ্জিন পাওয়া যেত, সেগুলো বিমানের পক্ষে নিতান্তই অনুপযুক্ত। কাজেই বাধ্য হয়ে নিজেরাই বসে গেলেন বিমানের উপযুক্ত ইঞ্জিন তৈরি করতে।
কয়েক মাসের নিরলস চেষ্টায় তৈরি হল তিন পাউন্ড ওজনের এক অশ্বশক্তি সম্পন্ন। ইঞ্জিন।
তারপর উইলবার ও অরভিল যেদিন কেরোলিনা প্রদেশের কিটি হক শহরের এক মাঠে তাদের উদ্ভাবিত পরীক্ষামূলক বিমানটি নিয়ে উপিস্থত হলেন, সেই দিনটি ছিল ১৯৩০ খ্রি: ১৭ ই ডিসেম্বর।
আগেই শহরময় রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল মানুষ বিমানে চেপে পাখির মত আকাশে উড়ে বেড়াবে। কথাটা কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না। তবু কৌতূহলী কয়েকজন মানুষ হাজির হল মাঠে।
তখনো এরোপ্লেন নামটি উদ্ভাবিত হয়নি। রাইট ভাইরা তাদের উড়ন্ত যানের নাম দিয়েছিলেন রাইট ফ্লাইয়ার।
ইঞ্জিন যুক্ত করে দুই ভাই মিলে বিমানটিতে উড়বার জন্য প্রস্তুত করে নিলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল বিমানে দু’জনের তো চড়বার ব্যবস্থা নেই। একজনকেই উড়তে হবে। দুজনে মিলেই বিমানটি নির্মাণ করলেও প্রথম আকাশে ওড়ার দুর্লভ সম্মান নিতে হবে একজনকেই।
কে প্রথম বিমান চালাবে শেষ পর্যন্ত টস করে তা ঠিক করা হল। টসে জিতে অরভিল বিমানে গিয়ে উঠলেন। উইলবার রইলেন নিচে। তাঁদের আবিষ্কারের সাফল্য দেখবার জন্য সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র জনা পাঁচেক মানুষ। সেদিন কি তারা ভাবতে পারছিলেন কী যুগান্তকারী ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ পেয়েছেন?
বিমানে চেপে নিজের জায়গায় বসে অরভিল প্রপেলার চালু করলেন। দু’পাশ থেকে দুটি দড়ি নিচে বাঁধা ছিল। উইলবার এবারে সেগুলো খুলে দিলেন। তারপর প্রাণপন শক্তিতে বিমানটিকে ঠেলতে আরম্ভ করলেন।
কিছুদূর গিয়েই শূন্যে লাফিয়ে উঠে আকাশে উড়ে চলল মানুষের হাতে তৈরি আকাশান। কিছুদূর মসৃণভাবে এগিয়ে গিয়ে পাক খেয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এল।
সেদিন রাইট ভাইয়ের তৈরি বিমান প্রথম দফায় বারো সেকেন্ড আকাশে ভেসে ছিল।
মানুষের ইতিহাসে আকাশ জয়ের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল ওই বারো সেকেণ্ড সময় নিয়ে। এ ছিল গতির যুগের শুভ সূচনা।
অরভিল নিরাপদে অবতরণ কররে আকাশে উড়লেন উইলবার। তিনি সবশুদ্ধ আকাশে ভেসে থাকলেন উনষাট সেকেন্ড, অতিক্রম করলেন ৮২০ ফুট দূরত্ব।
বাতাসের বেগ বাড়ছিল বলে সেদিন আর আকাশে ওড়া সম্ভব হয়নি।
ঐতিহাসিক ঘটাটি এমনভাবে ঘটল যে পৃথিবীর মানুষ তার কোন সংবাদই জানতে পারল না। কেবল কিট হক শহরে রটে গেল, দুজন মানুষ যাদু মন্ত্র বলে পাখির মত আকাশে উড়েছে।
সাফল্যের আনন্দের উত্তেজনা কাটিয়ে উঠতে দিন কতক লাগল। তারপর দুভাই মিলে কিছুদিনের চেষ্টাতেই আগের চাইতে অনেক বড় আর শক্তিশালী বিমান তৈরি করে ফেললেন।