সুদীর্ঘ ২০টি বছর কবি কাটিয়েছেন গজনীতে। তাঁর জীবনের মূল্যবান সময় ও শ্রম ব্যয় হয়েছে এখানে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে এবং রিক্ত হস্তে জীবন সায়াহ্নে গজনী ত্যাগ করে আবার বের হতে হল অজানা অচেনা নিরাপদ এক আশ্রয়ের সন্ধানে। গজনী ত্যাগ করার পূর্বে কবি সুলতান মাহমুদের এ হীনমন্যতার জন্যে তাঁকে গালমন্দ করে একটি ব্যঙ্গ রসাত্মক কবিতা লিখেন এবং তা মসজিদের দেয়ালে টাঙিয়ে রাতের অন্ধকারে গজনী ত্যাগ করেন।
ইতিপূর্বে কবির সুখ্যাতি দেশ বিদেশে যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল; তদ্রূট রাজদরবারে কবির ভাগ্য বিপর্যয়ের কথাও ইতিমধ্যে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ল। গজনী ত্যাগ করে কবি ‘কুহেস্তান’ রাজ্য রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেমের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। কবি ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের প্রতারণা ও হীনমন্যতার কথা ভুলতে পারলেন না। এখানে অবস্থানকালেই কবি সুলতান মাহমুদকে উপলক্ষ্য করে একটি ব্যাঙ্গরসাত্মক কাব্য প্রণয়ন করেন। সুলতান মাহমুদ ছিলেন রাজা নসরুদ্দিন মহতাসেমের একান্ত বন্ধু মানুষ। তাই রাজা কাব্যটি পাঠ করে খুব দুঃখ পান। কাব্যটি বন্ধুর জন্যে খুবই অবমাননাকর মনে করে রাজা কবিকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে কাব্যটি কিছু অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করেন এবং তা বিনষ্ট করেন। রাজনৈতিক আশ্রয়ে এখানে কবির দিনগুলো খুবই সম্মানজনক ও আনন্দের সাথে কেটেছিল। কবিকে গ্রহণ করার জন্যে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমন্ত্রণ আসে; কিন্তু কবি কোন আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে এখান থেকে চলে যান বাগদাদে। বাগদাদের তৎকালীন শাসনকর্তা কবিকে পেয়ে খুবই আনন্দিত হন। বাগদাদ অবস্থান কালে কবি ইউসুফ জ্বলেখার কাহিনী নিয়ে ১৮,০০০ শ্লোকের একটি প্রেমের কাব্য রচনা করেন; কিন্তু কাব্যটি অতীতের গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এছাড়া তিনি আরো বহু কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। বাগদাদে কিছুদিন অবস্থান করে কবি চলে যান নিজ মাতৃভূমি তুস নগরে
ইতিমধ্যে ন্যায় বিচারক হিসেবে পরিচিত সুলতান মাহমুদ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, কবি তাঁর প্রতিশ্রুত স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে দুঃখ পেয়েছেন। রাজসভার অন্যান্য কবি এবং আমলারা কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল, এ কথাও সুলতানের নিকট আর গোপন রইল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দীকে রাজপদ থেকে বহিষ্কার করেন এবং অনতিবিলম্বে কবিকে ফিরিয়ে আনার সংকল্প ব্যক্ত করেন। কিন্তু মানব মন স্থায়ী নয়। সুলতানকে হেয় করে কবির পূর্বে লেখা কবিতাটি সুলতানের মনে পড়ে যায়। এতে সুলতান ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে কবিকে গ্রেফতার করে রাজদরবারে নিয়ে আসার জন্যে একটি ওয়ার, আম জুয়ে খোলদাশ বহাঙ্গামে আব
ব’বেখ্ আঙ্গবান রেযী ও শীরে নাব,
ছরঞ্জামে গওহর ব’কার আওরাদ
হোমা মিওয়ায়ে তল্খ বর আওরাদ। বতাটি ছিল নিম্নরূপঃ
“আগর শাহ্রা শাহ্হুদে পেদর,
বছর নেহাদে মা’বা তাজ ও ঘর।
চু আন্দর তাবারেশ বোজরগী না বুদ্,পত্রসহ বাগদাদে দূত প্রেরণ করেন।
আরাস্ত কে নামে বোজরগানস শনুদ।
দরখতে কে তল্খ আস্ত উরা ছেরেশত,
গরশ্ দর নেশানী ব’বাগে বেহেশ,
ওয়ার, আম জুয়ে খোলদাশ বহাঙ্গামে আব
ব’বেখ্ আঙ্গবান রেযী ও শীরে নাব,
ছরঞ্জামে গওহর ব’কার আওরাদ
হোমা মিওয়ায়ে তখ বর আওরাদ।”
অর্থাৎ —
রাজবংশে হত যদি জন্ম তোমার
বখশিতে স্বর্ণমুদ্রা মুকুট সোনার।
উচ্চমান নাহি যার বংশের ভিতর
কেমনে সহিবে সে মানীর আদর?
তিক্তবীজ হতে যে তরুর জন্ম,
নন্দন কাননে তারে কর রোপণ
সিঞ্চন কর মূলে মন্দাকিনী ধারা,
মধু আর দুগ্ধে ভর খাদ্যের পশরা–
তথাপি ফলিবে তার আপন স্বভাব,
সতত সে তিক্ত ফল করবে প্রসব।
কিন্তু বাগদাদ থেকে কবিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বরং বাগদাদের শাসনকর্তা সুলতানের প্রেরিত পত্রের এক কোণে আলিফ, লাম ও মীম এ তিনটি অক্ষর লিখে দেন। সুলতান মাহমুদ পত্রে এ তিনটি অক্ষর দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কিংবা রাজদরবারে কবি ফেরদৌসী’র অভাব দারুণ ভাবে অনুভব করেন। আজ যদি কবি ফেরদৌসী দরবারে থাকতেন তাহলে এর অর্থ বুঝার জন্যে রাজদরবারের বাইরে যেতে হত না।
সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুয়েস্তানের রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেম কবি ফেরদৌসীর উচ্চ প্রশংসা করে সুলতান মাহমুদের নিকট একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাঠান্তে সুলতান খুব মর্মাহত হন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, সুলতান কবির প্রতি ন্যায় বিচার করেননি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের কুপরামর্শে তিনি কবির প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন। তাই সুলতান নিজেকেই অপরাধী মনে করে কবি ফেরদৌকে ক্ষমা করে দেন এবং কবির প্রতি সুলতানের সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন সরূপ কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রা সহ কবির জন্মভূমি ইরানের তুস নগরীতে কবির নিজ বাড়িতে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু দূত যখন স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যান তখন কবি পৃথিবীতে বেঁচে নেই।
১০২০ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১০১৪ খ্রিস্টাব্দে কবি এ অশান্তময় পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। কবির ইন্তেকালের হাজার বছর অতিবাহিত হলেও কবি ও কাব্য ও সাহিত্য পৃথিবীতে রেখে গেছেন তাতে মুসলিম জাতি কর্তৃক কবিকে কখনো ভুলার মত নয়।
৯০. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯)
তড়িৎবিজ্ঞানে বিশেষ করে তড়িৎ ও তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ তত্ত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর আবিষ্কৃত সূত্রটি তড়িৎ বিজ্ঞানে ম্যাক্সওয়েলের কর্কশ্রু-সূত্র নামে প্রসিদ্ধ। তড়িৎপ্রবাহের ফলে চুম্বক-শলাকার দিক নির্ণয় করা হয় এই সূত্রের সাহায্যে।