মহাকবি ফেরদৌসী’র জীবন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বিশেষ কিছু জানা যায় না। তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পরে ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামি আরযী তাঁর ‘দিবাচায়, ফেরদৌসী সম্পর্কে যা লিপিবদ্ধ করেছেন তা থেকে জানা যায়, মহাকবি ফেরদৌসী ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের সমরকন্দের অন্তর্গত তুস নগরের “বাঝ’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ আবুল কাশেম। ‘ফেরদৌসী’ তাঁর উপাধি। গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে এ উপাধি দিয়েছিলেন। সে থেকেই তিনি ফেরদৌসী নামে খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ফেরদৌসী ভাল লেখাপড়া শিখেছিলেন। তাঁর আর্থিক অবস্থাও ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। জানা যায়, তিনি উত্তারিধকার সূত্রে অনেক জায়গা জমি পেরেছিলেন এবং এ সব জমি থেকে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ আয় হত।
তিনি বাল্য বয়স থেকেই কবিতা লিখতে ভালবাসতেন। কম বয়সেই বিয়ে করেন। যৌবনে তিনি একান্তভাবে কবিতা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন এবং রাজকীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ছোট্ট নদীর তীরে বসে কাব্য লিখতেন। সুখ ও শান্তিময় জীবনের দিনগুলো এখানেই তিনি কাটাতেন। কিন্তু সুখ তার জীবনে বেশীদিন স্থায়ী হল না। তার পরিবারে তুসের শাসনকর্তার খারাপ দৃষ্টিতে পতিত হল। অবশেষে নিজ গৃহে অবস্থান করাই ছিল তার জন্যে দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাঁর মাত্র একটি কন্যা সন্তান ছিল। কন্যাকে সৎপাত্রে বিবাহ দেয়া ছিল তার জীবনের বড় আশা। এছাড়া নিজ দেশের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও অভাব-অনটন দেখে তার মন প্রায়ই কেঁদে উঠত। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যেভাবেই হোক তিনি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন। কিন্তু তার মনের এ আকা আর পূরণ হল না। নিজ গৃহে অবস্থান করাই যখন তাঁর অসম্ভব হয়ে উঠল, তখন জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন কিভাবে। তিনি কন্যাকে সাথে নিয়ে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পড়লেন অজানা এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তাঁর জীবনের এ দুঃসময়ে সাক্ষাৎ পেলেন গজনীয় সুলতান মাহমুদের।
৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনীয় সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি দেশ বিদেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন এবং তাছাড়া দরবারে দেশ বিদেশের কবিদের কবিতা আবৃত্তির আসর হত। মহাকবি মুহাম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের নিকট যথাযথ কদর পাবেন চিন্তা করে গজনীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গজনীর রাজ দরবারে প্রবেশ করা ছিল তখন কঠিন ব্যাপার। তিনি দরবারের অন্যান্য কবিদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। অবশেষে সুলতান মাহমুদের উজির মোহেক বাহাদুরের সহযোগিতায় তিনি রাজদরবারে প্রবেশ করেন। সুলতানের সাথে কবির প্রথম পরিচয় হয় কয়েকটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে। সুলতানের সাথে প্রথম পরিচয় হয় কয়েকটি কবিতা পাঠের মাধ্যমে। প্রথম সাক্ষাতেই সুলতান কবির আবৃত্তি করা কয়েকটি কবিতা শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং এ বলে কবিকে সংবর্ধনা করলেন,
“আয় ফেরদৌসী, তু দরবারে মে ফেরদৌস কারদী।
অর্থাৎ হে ফেরদৌসী, তুমি সত্যিই আমার দরবারকে বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছ।
এ থেকেই কবির নাম ফেরদৌসী হল এবং পরবর্তীতে তিনি ফেরদৌসী হিসেবেই খ্যাতি লাভ করেন। সুলতান কবির জন্যে পৃথকভাবে উন্নতমানের বাসস্থান ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং কবিকে রাজকবি হিসেবে মনোনীত করেন। আস্তে আস্তে কবি ফেরদৌসীর সাথে সুলতান মাহমুদের সম্পর্ক গম্ভীর হয়ে যায়। কবির কবিতা ও তার জ্ঞান বুদ্ধিতে সুলতান তার প্রতি মুগ্ধ হন। কিন্তু এখানেও সুলতানের সাথে কবির। গভীর সম্পর্ক আজীবন স্থায়ী হল না।
কবি ফেরদৌসী’র সাথে সুলতানের গভীর সম্পর্ক এবং রাজদরবারে কবির শ্রেষ্ঠ সম্মান দেখে রাজসভার অন্যান্য কবিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল এবং কবিকে রাজদরবার থেকে বের করার জন্যে কবির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করল। অন্যদিকে সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দীও কবির সাথে গোপনে শত্রুতা আরম্ভ করলো। ইতিমধ্যে সুলতান মাহমুদ কবিকে ‘মহাকাব্য শাহনামা’ রচনা করার অনুরোধ জানান এবং এর প্রতিটি শ্লোকের জন্যে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যতদূর জানা যায়, কবি সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রম করে শাহনামা’ রচনা করেন। এর মধ্যে শেষের ২০ বছর কবি রাজসভাতে কাটান। শাহনামা’ পৃথিবীর মহাকাব্য সমূহের অন্যতম। ইহা ৭টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত এবং ৬০ হাজার শ্লোক রয়েছে এতে। কাব্যের কোথাও অশ্লীল বাক্য বা ইতর উপমার প্রয়োগ নেই। কবি নিযামীর মতে ‘শাহনামা’ কাব্য রচনা শেষ হয় হিজরী ৩৯৩ সনে। ‘শাহনামা’ কাব্য রচনা শেষে সুলতান রাজদরবারের কতিপয় ঈর্ষাপরায়ণ ও ষড়যন্ত্রকারীর কুমন্ত্রণা শুনে তার প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা মাতন্তরে ৬০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। সুলতান কবির বিরুদ্ধে আমলাদের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পারেননি। এদিকে কবি ফেরদৌসী সুলতানের প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে ক্রোধে, ক্ষোভে ও দুঃখে কিংকর্তবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কবি অর্থের লোভী ছিলেন না। বরং সুদীর্ঘ ৩০ বছর পরিশ্রমের বিনিময়ে তাকে যে অর্থ দেয়া হয়েছে তা কবি নিজের জন্যে অপমান মনে করেছেন। ফেরদৌসী দীন হতে পারেন কিন্তু তাঁর আত্মা দীন নয়। এছাড়া এ অর্থ দিয়ে নিজ দেশের অসহায়, গরীব, নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনগণের এবং কন্যা সন্তানের যে উপকার করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন তা যেন সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। সুলতান হয়ে তিনি কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারলেন? এসব কথা চিন্তা করেই কবি সুলতানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং কবিকে সুলতানের দেয়া সমুদয় অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। শুধু তাই নয়, সুলতানের দেয় সমুদয় অর্থ ভৃত্য, স্নানাগারের রক্ষক ও নিকটস্থ গরীব লোকদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেন। রাজ পুরস্কারকে অপমান করার ঘটনা সুলতানের কানে পৌঁছল। রাজসভার অন্যান্য কবি ও আমলারা সুলতানকে বিষয়টি ভালভাবে বুঝায়নি বরং তারা সুলতানের নিকট কবির বিরদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন। তাঁরা সুলতানের নিকট কবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা বলে কবির বিরুদ্ধে সুলতানকে ক্ষেপিয়ে তোলেন। সুলতান ক্ষুব্ধ হয়ে কবিকে হাতির পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করার আদেশ দেন এবং পরক্ষণে এ আদেশ তুলে নিয়ে কবিকে গজনী ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।