দীর্ঘ অনুসন্ধানের কাজে নানা খনিজ খুঁজতে খুঁজতে মাজা খুঁজে পান পিচ ব্লেড। এর মধ্যেই পাওয়া গেল ভয়ঙ্কর সেই বিকিরণ। ইউরেনিয়ামেরই অনুরূপ সেই বিকিরণ এই খনিজের সারা অবয়ব জুড়ে।
আরও একটা ব্যাপার হল, খনিজ পিচ ব্লেড থেকে যে বিকিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তার তেজ ইউরেনিয়ামের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
ধীরে ধীরে মার্জা খনিজ পিচ ব্লেড থেকে বিশুদ্ধ অবস্থা অর্থাৎ বিশেষ তাপমাত্রায় কতগুলো পদার্থ যোগ করে নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এক ধরনের মৌলকে আলাদা করে নিলেন।
স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘ চার বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে প্রকৃতির এক অজানা রহস্যের উন্মোচন ঘটানো সম্ভব হয়। মার্জা দুটি সম্পূর্ণ নতুন মৌল আবিষ্কার করে পৃথক করে নেন।
এই মৌল দুটোর একটির নাম দিলেন পোলনিয়াম। মাতৃভূমি পোল্যাণ্ডের নামে এই মৌলটিকে উৎসর্গ করে এই নাম দিলেন।
দ্বিতীয় মৌলটির নাম দেন রেডিয়াম। ইউরেনিয়াম নামের এক অংশ হেঁটে রেডিয়েশন বা বিকিরণ শব্দের রেডি বসিয়ে নামকরণ করা হল।
নতুন আবিষ্কৃত রেডিয়াম মৌলটির তীব্রতা ইউরেনিয়ামের তুলনায় পনের লক্ষ গুণ বেশি। পিয়েরির তৈরি বিকিরণের পরিমাণ পরিমাপের যন্ত্রই তা বলে দিল।
এই বিস্ময়কর আবিস্কারের কথা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন উঠল।
কুরি দম্পত্তির এই মহৎ গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে হেনরি বেকেরেলের সঙ্গে যুক্তভাবে তাদের দেওয়া হল ১৯০৩ খ্রি: পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার।
অসুস্থতার জন্য তাদের কারোর পক্ষেই সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে গিয়ে পুরস্কার নেওয়া সম্ভব হয়নি। আশ্চর্য যে এই বিজ্ঞানী দম্পতির জন্য ফরাসি সরকারের কোন তাপ উত্তাপ দেখা গেল না। না দেওয়া হল তাদের কোন আর্থিক সাহায্য না করে দেওয়া হল একটি ভাল ল্যাবরেটরি। কোন সম্মান প্রদর্শন তো দূরের কথা।
গবেষণার সুবাদে কেবল ১৯০৪ খ্রি: মাদাম করি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করলেন।
রেডিয়াম ও পোলনিয়াম আবিস্কার ও এই দুই দুটি ধাতব মৌলের নিষ্কাশন পদ্ধতি উদ্ভাবনের পর বিশ্ববিজ্ঞানের নতুন একটি শাখার উদ্ভব হল। তার নাম রেডিয়েশন সায়েন্স বা তেজস্ক্রিয় বিজ্ঞান।
মার্জা রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন বটে, এর তেজস্ক্রিয়তার স্বরূপ তিনি নির্ণয় করে উঠতে পারেননি
তাঁর অসম্পূর্ণ কাজটি করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড ১৯০২ খ্রি:। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান যে তেজস্ক্রিয়তা হল আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের স্বতঃস্ফূর্ত ভাঙ্গন দশা।
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রচণ্ড চাপে অবস্থিত মৌল কণিকা প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যাগত তারতম্যের ফলেই ঘটল ভাঙ্গন দশা।
নিউক্লিয়াসের এই বিশেষ অবস্থার কথা রাদারফোর্ডই সর্বপ্রথম বিশ্ববিজ্ঞানকে অবহিত করেন।
১৯০৬ খ্রি: ১৯শে এপ্রিল, প্যারিসের এক রাস্তায় আকস্মিক দুর্ঘটনায় পিয়েরি কুরির মৃত্যু হয়।
এ বিপর্যয়ের কিছুদিন পরেই মাদাম কুরি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদে মনোনীত হলেন।
মাদাম কুরিই হলেন ফ্রান্সের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে প্রথম মহিলা যিনি অধ্যাপনার আসনে ব্রতী হন।
১৯১১ খ্রি: দ্বিতীয়বার নোবেল পেলেন মাদাম কুরি। এবারে পদার্থ বিদ্যায় নয়। রসায়নে।
রেডিয়ামকে বিশুদ্ধ মৌলরূপে পৃথক করা ও তার পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করার কৃতিত্বের জন্যই তিনি এই পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
এই সুবাদে ফরাসি সরকার মাদাম কুরিকে একটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি উপহার দিয়ে তাদের পূর্বেকার ভুলের সংশোধন করলেন। এই ল্যাবরেটরির নাম রাখা হয় কুরি ইনস্টিটিউট অব রেডিয়াম। মাদাম কুরিই হলেন এই প্রতিষ্ঠানের সর্বেসর্বা।
১৯১৪ খ্রি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। মানবতাবাদী মাদাম কুরি আর ল্যাবরেটরির ঘরে আবদ্ধ থাকতে পারলেন না। গবেষণা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে আহতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তার আবিস্কৃত রেডিয়ামকে আহতদের চিকিৎসায় ব্যবহার করে তাদের সুস্থ করে তুলতে লাগলেন।
চার বছর পৃথিবীময় মৃত্যুর তাণ্ডব ঘটিয়ে অবশেষে ১৯১৮ খ্রি: মহাযুদ্ধের অবসান ঘটল। মাদাম কুরিও আবার ফিরে গেলেন তার ল্যাবরেটরিতে।
দীর্ঘকাল তেজস্ক্রিয় বিকিরণ নিয়ে গবেষণা করার ফলে মাদাম কুরি রক্তের কোষগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ফলে ১৯৩৪ খ্রি: তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন।
সমস্ত চিকিৎসা ও চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সেই বছরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বিশ্ববিজ্ঞানের এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভা।
৯. মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪১–১০২০ খ্রি:)
পৃথিবীর বুকে বিশ্ব বিখ্যাত যে ক’জন কবির আগমন ঘটেছে ‘মহাকবি ফেরদৌসী’র নাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি। বর্তমান যুগে ঘরে ঘরে যেমন কবির জন্ম হচ্ছে, একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের মিল দিতে পারলেই কবি হিসেবে পরিচিত হওয়া যায়, পরিচিত হতে না পারলেও জোর করে পরিচিত হবার চেষ্টা চালায়; কিংবা ২/১টি অশ্লীল শব্দ বা বাক্য সংযোজন করে আলোচিত হবার চেষ্টা করে; তখনকার দিনে এমনটি ছিল না। যেমন তেমন লোক কবিতা লিখতেন না। কবির মন, কবির দেখান শক্তি, কবির চিন্তা, কবির দেখার বিষয়বস্তু সাধারণ লোক হতে অনেক ভিন্ন। সাধারণ মানুষ যা দেখে, যা ভাবে সেগুলো কবির চোখে নতুন করে দেখা দেয় এবং বাস্তব জীবনের সত্যগুলো কবির হৃদয়ে জেগে ওঠে। বর্তমান অধিকাংশ কবিদের লেখা কবিতা একবার পড়লেই যেমন দ্বিতীয় বার পড়তে বছর আগে মহাকবি ফেরদৌসী ইন্তেকাল কারলেও আজও প্রায় প্রতিটি মুসলমানের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর লেখা কবিতা। কি যেন আকর্ষণ ও সত্য লুকিয়ে রয়েছে তাঁর কবিতায়; নেই কোন বিরক্তি, অতৃপ্তি ও তিক্ততা। যতবার পড়া হয় ততবারই যেন ইচ্ছে হয় শুনতে বা পড়তে।