সুখী সংসারের গৃহিণী ব্ৰনিয়া। তার ওপরে ততদিনে একটি সন্তানও হয়েছে তার। সংসারে খরচ তো বেড়েছে।
এর ওপর বোঝা হয়ে উপস্থিত হলে দিদি তো কোন সময়ে স্বামীর বিরাগভাজন হয়ে উঠতে পারেন।
এমনি সাত-পাঁচ ভেবে মার্জা দিদির বাড়িতে আর গেলেন না। প্যারিসের আলো বাতাসহীন বস্তি অঞ্চল লাতিন কোয়ার্টারে নামমাত্র ভাড়ায় মাথা গোঁজার মত একচিলতে একটা ঘর ভাড়া করলেন।
নরকতুল্য সেই নোংরা, চোর জোচ্চোর-ভবঘুরে ভরা পরিবেশে নতুন জীবন শুরু হলো মার্জার।
যেই স্বপ্ন নিয়ে প্যারিসে এসেছিলেন, তা বাতিল করে ভর্তি হলেন প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিদ্যার ক্লাশে।
এখানে নিজের নামও পাল্টে ফেললেন। মার্জার নতুন নাম হল মেরি ক্লোডোস্কো।
চরম দারিদ্র্য, অনাহারে ও অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন মার্জা। দিদি এই কৃসাধনের বিন্দুবিসর্গ-ও জানতে পেলেন না। বছর দুই এভাবেই কাটল। কিন্তু দীর্ঘদিন অনাহারে আধপেটা খেয়ে শরীর একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল, জীবনীশক্তিও শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছেছিল।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ করতে করতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। সহপাঠীদের শুশ্রূষায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে শুনলেন, ডাক্তার জানিয়েছেন, পুষ্টির অভাবে ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে।
বন্ধুরাই ডায়েরী হাটকে দিদি ব্রনিয়ার ঠিকানা জোগাড় করল। ব্রনিয়া খবর পেয়ে ছুটে এসে কঙ্কালসার বোনকে বাড়িতে নিয়ে তুললেন। দিদির আন্তরিক সেবাযত্নে সে যাত্রা প্রাণরক্ষা হল মার্জার।
সুস্থতা ফিরে পেতেই আবার ফিরে এলেন নিজের লাতিন কোয়ার্টারের নরকে। ব্ৰনিয়ার অনেক কাকুতি মিনতিতেও নিজের কঠিন জীবনসাধনার পরিবর্তন ঘটালেন না।
১৮৯৩ খ্রি: মার্জা সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক হলেন। পরের বছর গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলেন।
এতদিন পরে একটু হাঁপ ছাড়বার অবকাশ পেলেন মার্জা। এই সময়েই একদিন তাঁর এক বন্ধু কোভস্কির বাড়িতে আলাপ হল পদার্থবিদ্যার এক তরুণ গবেষকের সঙ্গে। তার নাম পিয়েরি কুরি।
এই ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বিদ্যুতের সূক্ষ্ম পরিমাপক যন্ত্র ও পিজো বিদ্যুৎ আবিস্কার করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন।
পরবর্তীকালে আদর্শবাদী গবেষণাপাগল এই তরুণ গবেষকই মার্জাকে জীবনসঙ্গিনী করে নেন। মার্জা হলেন মাদাম কুরি। সময়টা ১৮৯৫ খ্রি:।
বিশ্ববিজ্ঞানের পরম বিস্ময়কর দম্পতির জীবনের যাত্রারম্ভ হয় এভাবেই।
পিয়েরি প্যারিসের এক মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পড়ান। তবে গবেষণার সূত্রে পদার্থবিদ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত লাভ করেছেন। আর্থিক অবস্থা খুব সুবিধের নয়।
মাসমাইনের সামান্য টাকাতেই দুজনে মিলে কোনরকমে সংসার সামলাতে লাগলেন। এরই মধ্যে তাদের স্বপ্ন দেখারও বিরাম নেই।
বিয়ের দু’বছর পরেই ১৮৯৭ খ্রি: কুরি দম্পতির প্রথম কন্যা সন্তান আইরিনের জন্ম। হল।
কুরি দম্পতির এই প্রথম কন্যাটি পরবর্তীকালে প্রমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন।
১৯২৬ খ্রি: আইরিনের বিয়ে হয়েছিল রেডিরিক জোলিয়েট নামের এক পদার্থ। বিজ্ঞানীর সঙ্গে।
স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে গবেষণা করে ১৯৩৫ খ্রি: নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিস্কার করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
আইরিনের জন্মের কয়েক বছর পরেই দ্বিতীয় কন্যা ইভার জন্ম হয়। সংসারের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে খরচ। কিন্তু সম্বল তো সেই মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাসমাইনের টাকা।
সংসারের সব অভাব-অভিযোগ ভুলে রইলেন কুরি দম্পতি নিজেদের গবেষণার মধ্যে ডুবে থেকে।
১৯৯৬ খ্রি: হেনরি বেকেরেল নামে এক ফরাসি বিজ্ঞানী ইউরেনিয়াম ঘটিত খনিজ থেকে এক রশ্মি আবিস্কার করেন। তার নাম গামা রশ্মি। এই আবিস্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে থাকেন যে ইউরেনিয়াম বা তার কোনও যৌগের অবশ্যই আলো শোষণের ক্ষমতা রয়েছে। সেই আলোই নিশ্চয় রশ্মির আকারে বিচ্ছুরিত হয়।
বিজ্ঞানীরা অনুমানই যা করেছিলেন, ভাবনার স্বপক্ষে কোন বাস্তব প্রমাণ খাড়া করতে পারছিলেন না।
পিয়েরি মার্জাকে পরামর্শ দিলেন এই সমস্যাটিকে নিয়েই তার ডক্টরেটের থিসিস তৈরি করতে।
গবেষণার কাজে নানা সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দরকার। কিন্তু সেসব কিনবার টাকা কোথায়? মার্জা হতাশ না হয়ে স্বামীর তৈরি যন্ত্রপাতি, বিকিরণ পরিমাপের যন্ত্র–এসব নিয়েই গবেষণার জন্য তৈরি হলেন।
পিয়েরি যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, সেখানে একটি পরিত্যক্ত ঘর ছিল। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানেই ল্যাবরেটরি গুছিয়ে নেওয়া হল। তারপর দুজনে মিলে আরম্ভ করলেন গবেষণা।
মার্জা দেখলেন, ইউরেনিয়াম ঘটিত যৌগই কেবল নয়, ইউরেনিয়াম ধাতু থেকেও রহস্যময় বিকিরণ বেপরোয়াভাবে বেরিয়ে আসছে। এই বিকিরণের গোপন উৎস সন্ধান করতে গিয়ে মাঞ্জা লক্ষ করলেন পরমাণুর মধ্যেই রয়েছে এই গোপন উৎস।
বিকিরণের বৈশিষ্ট্যটি ইউরেনিয়াম ধাতুরই একটা পারমাণবিক অবস্থা। বিকিরণের এই বৈশিষ্ট্যই হল রেডিও অ্যাকটিভিটি।
ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে এমন কোন মৌল আরও আছে কিনা, সেই অনুসন্ধান কাজে এবারে মার্জা আত্মনিয়োগ করেন।