তাঁর একটি সিদ্ধান্ত যেমন ভারী ও হাল্কা এই দুই বস্তু ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলে দুটিই একসময়ে নিচে পড়বে।
বহু শতক পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও পিসা শহরে পরীক্ষা দ্বারা এই তত্ত্ব ভ্রান্ত বলে প্রমান করেছিলেন।
তিনি দেখিয়েছিলেন, বায়ুপূর্ণ স্থানে বায়ুঘাতের জন্য এরকম হতে পারে। কিন্তু বায়ুহীন স্থানে ভারী ও হাল্কা বস্তু একসঙ্গে নিচে ফেললে দুটিই একসময়ে নিচে পড়বে।
অ্যারিস্টটলের মত ছিল, স্থির বস্তুকে ধাক্কা দিয়ে বা বেগ সঞ্চার করে চির গতিময়তা দান করা যায়।
আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নিউটন অ্যারিস্টটলের এই সিদ্ধান্তটিকে সংশোধন করে প্রকৃত সত্যের ভিত্তিতে আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর প্রথম গতিসূত্র।
তিনি প্রমাণ করে দেখান, যে কোন গতিশীল বস্তুরই গতিপথ হয় সরল রেখা ধরে।
অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন পৃথিবী গঠিত হেয়ছে ক্ষিতি, অপঃ,তেজ ও মরুৎ এই চারটি মৌলিক বস্তৃদ্বারা। কিন্তু পরবর্তীকালে জানা গেছে পদার্থ সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের সিদ্ধান্তটি ভুল। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অর্থাৎ মাটি, জল, আগুন ও বায়ু এগুলো কোনটাই মৌলিক পদার্থ নয়।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তি প্রমাণ রেখেছেন অ্যারিস্টটল। কিন্তু পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে ভুল থাকার জন্য তাঁর সিদ্ধান্তও সঠিক হতে পারেনি। তিনি জানিয়েছিলেন পৃথিবীই হল সৌরজগতের কেন্দ্র। একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে গ্রহ ও নক্ষত্রেরা অবিরাম ঘুরছে। চাঁদের আলোকেও তার নিজস্ব আলো বলেই বর্ণনা করেছেন তিনি। বহু শতাব্দী পরে অ্যারিস্টটলের এই সব সিদ্ধান্ত শুধরে দিয়েছেন গ্যালিলিও কেপলার প্রমুখ বিজ্ঞানীগণ।
তারাপ্রমাণ করে দেখিয়েছেন পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র রেখে। দ্বিতীয়তঃ চাঁদের নিজস্ব আলো বলতে কিছু নেই। সূর্যের আলোতেই তার আলোকিত রূপ প্রকাশিত হয় জ্যোছনা হয়ে। চাঁদের ভেতর দিয়ে আসে বলেই জ্যোছনা তাপমুক্ত। প্লেটোর দার্শনিক চিন্তার সূত্র ধরে তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল যা লিখে রেখে গেছেন, বৈচিত্র্যে ও বিস্তারে তা বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচায়ক। রাষ্ট্রনীতি, নাটক, কাব্য, বস্তুবিদ্যা, ভেষজবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, তর্কবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, সৌন্দর্যতত্ত্ব, প্রকৃতিবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, অলংকার শাস্ত্র, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বহু বিষয়েই অ্যারিস্টটলের জিজ্ঞাসা ছিল অত্যন্ত প্রবল।
ঈশ্বর, রাষ্ট্র ও মানুষ–এই তিনটি বিষয়ে অ্যারিস্টটল নতুন কথা বলেছেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, ঈশ্বরকে প্রসন্ন করার অভিপ্রায়ের প্রার্থনা ব্যাপারটা মানুষের মুখতাই প্রমাণ করে। মানুষের সুখ-দুঃখ ঈশ্বরকে স্পর্শ করে না। তবে মানুষের সব চিন্তার প্রেরয়িতা ঈশ্বর। ঈশ্বরের চালক নেই, মানুষের আবেগ আছে, হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ ঈশ্বরের ক্ষেত্রে থাকতে পারে না।
জগদব্যাপারের নিয়ম অনুসারে মানুষের পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু ঈশ্বর অপরিবর্তনীয়। মানুষ ঈশ্বরকে ভালবাসে, ঈশ্বরের ভালবাসা বলে হৃদয়াবেগ থাকতে পারে না।
ঈশ্বরই মানুষের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করে একথা ঠিক নয়, ঈশ্বর স্বপ্নচারী। বিশ্ব-প্রপঞ্চের মূল শক্তি বা Primal Energy বলতে আধুনিক বিজ্ঞানীরা যা বোঝেন অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরও সেই শক্তি-সত্তা। রাষ্ট্র সম্পর্কে তিনি বলেছেন, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, দলতন্ত্র (oli garchy), গণতন্ত্র কোন তন্ত্রই দুষ্টের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনা। এসবের মধ্যে স্বৈরতন্ত্র নিকৃষ্ট। অ্যারিস্টটল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করতেন সংবিধান সম্মত শাসন পদ্ধতি বা Constitutional Government। তাঁর মতে শ্ৰেণীতন্ত্র বা Dictatorship of a class স্বৈরতন্ত্রেরই সমকক্ষ।
সাম্যবাদ বা Communism তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করতেন না। বলতেন, সাম্যবাদী শাসন ব্যবস্থায় হিংসার আগুন দেশকে ধ্বংস করবে।
দেশের উন্নতি যদি কাম্য হয় তাহলে নিশ্চয় ব্যক্তিগত মালিকানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করতেন অ্যারিস্টটল।
তিনি বুঝেছিলেন, প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। বৃদ্ধ এবং প্রজ্ঞরা নির্দেশ দেবে, নবীনেরা তাদের আজ্ঞা পালন করবে। অ্যারিস্টটল বলতেন, শাসনতন্ত্রের একটি প্রধান লক্ষ হবে শিক্ষার উৎকর্ষ সাধন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সম্পর্ক বলতে গিয়ে অ্যারিস্টটল খাঁটি মানুষ তাকেই বলেছেন যার নিজে সুখী হবার এবং অপরকে সুখী করবার যোগ্যতা আছে। তিনি বলতেন, দয়া প্রদর্শন মানুষের কর্তব্য, তবে দয়া করা মানে অনুগ্রহ করা নয়। আশু ফল প্রদান না করলেও সৎকর্মের একটা নিজস্ব মূল্য থাকে।
পরনিন্দা, বিদ্বেষ, অপরের ক্ষতিসাধন–এসব প্রবণতা খাঁটি মানুষের থাকতেই পারে না। গ্রিস দেশের প্রাচীন সংস্কৃতি সমগ্র বিশ্বকে চিন্তার মুক্তির সাধনায় প্রেরণা দিয়েছে। এই প্রসেঙ্গ তিনজনের অবদান বিশ্ব মানস অবতন মস্তকে বহন করে চলেছে। এঁরা হলেন সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটল।
প্লেটো তাঁর গুরুর তত্ত্বাবলীর বিচারবিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করেছেন বলেই সক্রেটিসকে আজও আমরা জানতে পারছি।
প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলও তেমনই গুরুর তত্ত্ববাদের সূত্র ধরেই অবিস্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করে গেছেন।