অন্যদিকে অ্যারিস্টটল ছিলেন বস্তুবাদে বিশ্বাসী। লৌকিক জগতের প্রতিই তার আকর্ষণ ছিল বেশি। সজীব পদার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চিন্তা করতেই তিনি বেশি ভালবাসতেন।
জীব জগতের অনেক কিছুরই শ্রেণীবিভাগ করেছিলেন অ্যারিস্টটল। সেই যুগে এই বিষয়ে মাথা ঘামাতে অপর কোন বিজ্ঞানীই উৎসাহ বোধ করতেন না।
পৃথিবী অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিতে ছিল গতিময়।
মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞান ও দর্শনের খ্যাতি সমস্ত গ্রীসে ছড়িয়ে পড়েছিল।
৩৪২ খ্রি: পূ: প্লেটোর মৃত্যু হয়। তার পরে আকাঁদেমির চালক অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন অ্যারিস্টটল। কিন্তু এথেন্সের অধিবাসীরা তাঁকে বিদেশী বলেই মনে করত। তাই দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চালক অধ্যাপকের পদটি তার লাভ করা হল না।
এথেন্সে আর থাকতে মন চাইল না। অ্যারিস্টটল তখন এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত আতরনিউস নামক শহরে চলে আসেন।
এখানে তাঁর এক সহপাঠী হেরমিআ বাস করতেন। বন্ধুর বাড়িতেই এসে উঠলেন তিনি।
এখানে তিন বছর ছিলেন তিনি। হেরমিআর বোন পুথিয়াকে (Pythia) বিয়ে করে অনেক উপহার লাভ করেন।
ম্যাসিডনের রাজপরিবারের সঙ্গে পিতার সূত্রেই পরিচয় ঘটেছিল অ্যারিস্টটলের। রাজকুমার ফিলিপের সঙ্গে জানাশোনাও ছিল। তাঁর তিনি তখন রাজা হয়েছেন। অ্যারিস্টটলের গুণগ্রাহী ও ভক্তদের মধ্যে রাজাও ছিলেন অন্যতম।
আতরনিউসে থাকার সময়েই অ্যারিস্টটল রাজা ফিলিপের একটি চিঠি পেলেন। রাজা তাঁর বালকপুত্র ফিলিপের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে অনুরোধ পাঠিয়েছেন।
অ্যারিস্টটল সানন্দে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং ম্যাসিডনে ফিরে এলেন।
রাজকুমার আলেকজান্ডারের যখন চৌদ্দ বছর বয়স, সেই সময় অ্যারিস্টটল তাঁকে ছাত্র হিসেবে পান। প্রথম দর্শনেই দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
সাতবছর সময়ের মধ্যেই অ্যারিস্টটল রাজকুমার আলেকজান্ডারকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।
ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শনে অসাধারণ জ্ঞানার্জন করেছিলেন আলেকজাণ্ডার। গুরুর কাছ থেকে তিনি আরও লাভ করেছিলেন বিশ্বকে জানবার তীব্র পিপাসা।
বিজ্ঞান মনস্কতা, অসামান্য তেজ ও সাহস।
এই আন্তর সম্পদের প্রেরণাতেই একদিন তিনি ঘর ছেড়ে বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।
একের পর এক দেশ তিনি জয় করেছেন, সেসব দেশের সভ্যতা ও কৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। অ্যারিস্টটলের শিক্ষা এভাবেই সার্থকতা লাভ করেছিল শিষ্য আলেকজাণ্ডারের মধ্যে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপ মারা গেলেন। সিংহাসনে বসলেন আলেকজাণ্ডার। সেই সময় তার বয়স একুশ।
অ্যারিস্টটল চলে এলেন এথেন্সে। এখানে নিজেই একটি লাইসিয়াম খুললেন। শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে চললো তাঁর গবেষণার কাজ। তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের নাম দিলেন পেরিপ্যাটেটিক স্কুল।
মৃত্যুর পূর্বে পর্যন্ত রাজা ফিলিপ অ্যারিস্টটলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আলেকজাণ্ডার রাজা হয়ে পিতার সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন।
অ্যারিস্টটল একবার স্থির করলেন প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে একটি এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করবেন।
উপাদান সংগ্রহের জন্য এক হাজার সহকারী গবেষক নিযুক্ত করা হল। তারা পৃথিবীর নানাস্থানে প্রেরিত হয়েছিলেন। এ কাজে তিনি অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন রাজকোষ থেকে।
সংগ্রাহকরা ঈজিয়ান সাগরের উত্তর-পূর্ব উপকূলের জল ও স্থলভাগ থেকে, লেমবস দ্বীপ থেকে সংগ্রহ করে আনতো নানা উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা। সেসব পাঠিয়ে দেওয়া হত এথেন্সে অ্যারিস্টটলের গবেষণাগারে।
এ্যারিস্টটল এসব নমুনা একে একে শ্ৰেণী ধরে সাজিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। এইভাবেই দিনে দিনে জীববিদ্যা ও সমুদ্রবিদ্যার ভূমিপ্রস্তুত হয়ে চলল।
সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জীবজন্তুর প্রজাতির গঠন ও প্রজনন কৌশল ধরে তিনি শ্রেণীবিন্যাস করেছিলন।
বিভিন্ন প্রাণীর নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবচ্ছেদ করে সেসবের পরিচয় ও কার্যকারিতার ব্যাখ্যাও করেছেন তিনি।
প্রাণী ও উদ্ভিদ বিদ্যা বিষয়ে অ্যারিস্টটলের সিদ্ধান্তই ১৮ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা অভ্রান্ত বলে মেনে নিয়েছেন।
জীবোৎপাদন ও জীবজন্তুর ওপর নানা বৈজ্ঞানিক বিবরণ নিয়ে তিনি প্রকাশ করেছিলেন হিস্টোরিয়া অ্যানিমিলিয়া বইটি।
বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী লিনিয়াস ও কুভিয়ারের আবির্ভাবের পরে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের নতুন শ্রেণীবিন্যাস সাধিত হয়েছিল। ফলে অ্যারিস্টটলের এই দুই বিভাগে অধিকাংশ কাজ বাতিল বলে গণ্য হয়েছিল।
যুক্তিবাদী অ্যারিস্টটল সকল কার্যেরই কারণ অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা করতেন যুক্তি দিয়ে। তার এই কার্যকারণ তত্ত্ব নিয়ে রচিত হয়েছিল ন্যায়শাস্ত্রের বই আরগান। এই গ্রন্থের ভিত্তিতে প্রধানতঃ নীতিশাস্ত্রকার রূপেই তিনি বিখ্যাত ও প্রচারিত হয়েছেন বেশি।
বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা করে তিনি ১০০০ মত তথ্যনিষ্ঠ বই রচনা করেছেন। তার বেশিরভাগ বইই অবশ্য মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যেসব বই রক্ষা পেয়েছে তার অধিকাংশই দর্শন ও নীতিবিদ্যা সংক্রান্ত।
জ্যোতির্বিদ্যা ও পদার্থবিদ্যায় তাঁর যেসব তত্ত্ব রয়েছে তার ভিত্তি দার্শনিক ভাবনার ওপরেই গড়ে উঠেছিল।