শুকনো জমিতে জলসেচের জন্য আর্কিমিডিস এক ধরনের প্যাচালো কর্ক ভ্রু উদ্ভাবন করেছিলেন। পাম্প আবিস্কারের আগে পর্যন্ত জল নিষ্কাশনের জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হত। এই কর্কশ্রুর এক প্রান্ত জলে ডোবানো থাকে। আনত অবস্থায় এটি ঘুরতে থাকল এর ভেতরের প্যাচানো পথে জল ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যায়।
গণিত বিষয়ে আর্কিমিডিসের আবিষ্কারগুলোও স্মরণীয় হয়ে আছে। বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত নির্ণয় সমতল ক্ষেত্রের সমত্ব সম্বন্ধে তত্ত্ব নির্ণয়, অধিবৃত্তীয় অংশগুলোর ক্ষেত্রফল নির্ণয় সমান ভূমি ও উচ্চতা বিশিষ্ট ত্রিভুজ ও অধিবৃত্তের অংশের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় ইত্যাদি বিজ্ঞান জগতে তাঁর বিশেষ অবদান রূপে স্বীকৃত।
একবার দেশে যুদ্ধের সময় সামান্য আতস কাঁচকে আর্কিমিডিস অস্ত্ররূপে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কৌশল আবিষ্কার করে সকলকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন।
রোমান সেনাপতি মার্সেলাস সৈন্যবাহিনী ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সাইরাকিউস আক্রমণ করেছিলেন। আর্কিমিডিস সেই সময় সরার মত ভেতরে গর্তওয়ালা বিরাট বিরাট আয়না এমনভাবে দেয়ালের গায়ে সাজিয়ে রাখলেন যে তাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে রোমানদের জাহাজগুলোতে আগুন ধরে যায়।
এছাড়াও সমর-কৌশল সম্পর্কিত তার বিভিন্ন আবিষ্কার রোমান সৈন্যদের নানাভাবে পর্যুদস্ত করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রোমান সৈন্যদের অস্ত্রাঘাতেই আর্কিমিডিস নিহত হন। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ২১২ অব্দ। রোমান বাহিনী রাতের অন্ধকারে সাইরাকিউসের প্রাচীর টপকে শহরে ঢুকে পড়েছিল। তাদের নির্বিচার হত্যা ও ধ্বংসলীলার শিকার হন আর্কিমিডিস। তিনি যখন বালির ওপর গণিত ও জ্যামিতি সংক্রান্ত বিষয়ে আঁকজোক করছিলেন সেই সময় রোমান সৈন্যরা তাকে হত্যা করে। যদিও রোমান সেনাপতি মার্সেলাস-এর আদেশ ছিল আর্কিমিডিসকে যেন হত্যা করা না হয়।
মৃত্যুর পর আর্কিমিডিসকে মার্সেলাস রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সহকারে সমাহিত করেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গেও কোন প্রকার অমর্যাদাকর ব্যবহার করা হয়নি।
৮৮. অ্যারিস্টটল (৩৮৫-৩২২খৃ. পূ.)
প্রাচীন গ্রীসের বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের গ্রীক নাম আরিস্তোতেলেস। জন্মেছিলেন ঈজিয়ান সাগরের উত্তর পশ্চিম তীরে চেলিসিডিসের অন্তর্গত স্টেগিরা নামের ছোট্ট এক শহরে। সময়টা খ্রিস্টের জন্মের ৩৮৫ বছর আগে। তার বাবা নিকোমাখুস ছিলেন ম্যাসিড়নিয়ার রাজা অ্যামিনটাসের চিকিৎসক ও বন্ধু। অ্যামিনটাস ছিলেন দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের ঠাকুর্দা।
পরিবারের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিমন্ডলে স্বভাবতঃই শিশু বয়স থেকেই তাঁর জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মায়।
প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন অ্যারিস্টটল। ফলে অতি অল্প বয়সেই অঙ্ক, বিজ্ঞান ইতিহাস দর্শন প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন।
কিশোর বয়সে তিনি মাঝেমাঝেই গিয়ে বসতেন ঈজিয়ানসাগরের ধারে। অশান্ত ঢেউয়ের ভাঙ্গা-গড়া, সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে আকাশের সুদূর প্রান্তে হারিয়ে যেত তাঁর ভাবালু দৃষ্টি।
বইতে পড়েছেন নানা দেশের কথা, সভ্যতার ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস, মনীষীদের রোমাঞ্চকর জীবন-কাহিনী ও আবিষ্কারের কথা।
তার মনও এই সময়ে অজানা জগতের রহস্য সন্ধানের স্বপ্ন দেখে, কল্পনায় নানা ছবি আঁকে।
সেই সময় রাজধানী এথেন্স ছিল সমগ্র গ্রীসের জ্ঞানচর্চার পীঠভূমি। বিশ্ববিখ্যাত সব পণ্ডিত সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় রত।
অ্যারিস্টটলের স্বপ্ন তিনিও এথেন্স যাবেন। সমুদ্র বিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিদ্যার চর্চায় তাঁর গভীর আগ্রহ–সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের পদপ্রান্তে বসে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করবেন।
বাবার মৃত্যুর পর সতের বছর বয়সে ৩৬৭ খ্রি: পূর্বাব্দে এথেন্সে আসেন।
প্লেটোর লাইসিয়ামের তখন খুব নামডাক। প্রাচীন গ্রীসে মনীষীরা বড় হলঘরে বসে দেশ-বিদেশের ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। অনেকটা আমাদের দেশের প্রাচীন পোবন বা গুরুগৃহের ধারাতেই এথেন্সেও শিক্ষাগুরুরা শিষ্যদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করতেন।
এই শিক্ষাশ্রমগুলোই লাইসিয়াম নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে লাইসিয়ামেরই নাম হয়েছে আকাডেমী।
মহাজ্ঞানী প্লেটোর লাইসিয়ামটিই পরিচিত ছিল এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয় নামে। জ্ঞান এবং অধ্যাপনার জন্য তাঁর খ্যাতি দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশেও পৌঁছেছিল।
প্লেটো ছিলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের সেরা ছাত্র। নানা বিষয়েই ছিল তার গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য।
অ্যারিস্টটল প্লেটোর লাইসিয়ামে নাম লেখালেন। এখানে তিনি স্বকীয় রুচিতে ও আচরণে সংশ্লিষ্ট সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন প্লেটোর প্রিয় ছাত্র।
দীর্ঘ কুড়ি বছরে সাহিত্য দর্শন, রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অঙ্ক জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ও সমুদ্র বিজ্ঞানে ব্যুৎপন্ন হন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা বিষয়েও শিক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন প্লেটোর প্রিয় ছাত্র।
প্লেটো তার টাইমেয়াস গ্রন্থে প্রিয়শিষ্য অ্যারিস্টটলের অসাধারণ জ্ঞানের কথা উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন।
এই দুই গুরুশিষ্যের চিন্তাধারার মধ্যে পার্থক্যও ছিল যথেষ্ট স্পষ্ট। প্লেটোর প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক। ছিলেন কল্পনাবিলাসী। অঙ্ক নিয়ে চিন্তায় বিভোর থাকতেই ভালবাসতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পৃথিবী গতিহীন এবং স্থির এক গ্রহ।