১৯৭৩ সালে দেশ জুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১১ই সেপ্টেম্বর প্রথমে নৌবাহিনী তারপর সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে। রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রমণ করে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট আলেন্দে। সারা দেশে সামরিক শাসন জারি হল। নিজের গৃহে বন্দী হলেন অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী কবি। বিছানায় শুয়েই কবি লিখলেন তাঁর শেষ কবিতা।
“নিক্সন ফ্রেই নিকোচেত
১৯৭৩ এই ভয়ঙ্কর সেপ্টেম্বর মাস
……..আমাদের ইতিহাসের
ক্ষুধার্ত হায়নার দল।
আমাদের বিজয় পতাকাকে
ছিন্নভিন্ন করেছে, লণ্ঠন করেছে
নিউইয়র্কের ক্ষুধার্ত নেকড়েগুলো
বেশ্যার দালাল…শুধুই অত্যাচার আর অত্যাচার কোন আইন নেই
শুধু ক্ষুধা আর চাবুক।”
সেই বন্দী অবস্থায় ১২ দিন পর ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে মারা গেলেন কবি। সামরিক শাসনের সমস্ত নিষেধ উপেক্ষা করে পথে বার হল লক্ষ লক্ষ মানুষ কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সেই তাদের প্রথম প্রতিবাদ।
৮৭. আর্কিমিডিস (২৮৭-২১২খৃ. অব্দ)
পৃথিবীর সর্বকালের সকল দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হিসেবে আর্কিমিডিসের নাম মানবজাতির ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তার ন্যায় পন্ডিত সেকালের ইউরোপে দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না।
এখনো পর্যন্ত তাঁর সমকক্ষ গণিতবিদ পৃথিবীতে খুব অল্পই জন্মেছেন। তাঁর চিন্তাধারা ও আবিষ্কার কৌশল আধুনিক বিজ্ঞানীদের পাথেয় রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। আনুমানিক খ্রি: পূর্ব ২৮৭ অব্দে গ্রীসের সিসিলির অন্তর্গত
সাইরাকিউস নগরে আর্কিমিডিসের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন সেকালের একজন সুপ্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ। তারই সাহচর্য ও উৎসাহে অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যামিতিবিদ্যার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং কালক্রমে বিজ্ঞান ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় প্রতিভারূপে অমরত্ব লাভ করেন।
সেকালে গ্রীস দেশেও প্রাচীন ভারতের মত গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভ করতে হত। এই ছিল প্রচলিত নিয়ম।
আর্কিমিডিসের লেখাপড়াও শুরু হয়েছিল সেভাবে আলেকজান্দ্রিয়ায়। তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন জ্যামিতির জনক ইউক্লিডের শিষ্য স্যামোসের কোনে। গুরুর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য ও শিক্ষায় তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছিল।
গুরুগৃহে শিক্ষা শেষ করে আর্কিমিডিস নিজের জন্মস্থান সাইরাকিউসেই বিজ্ঞানচর্চায় সারাজীবন অতিবাহিত করেন।
সাইরাকিউসের রাজা দ্বিতীয় হিয়েরো আর্কিমিডিসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং নিজের বন্ধু রূপে সম্মান দিতেন। হিয়েরোর অনুরোধে ও উৎসাহে পরবর্তীকালে তিনি নানা ধরনের কার্যকরী যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। চল্লিশটিরও বেশি যন্ত্র তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন।
রাজা হিয়েরোর সোনার মুকুট নিয়ে তাঁর জগদ্বিখ্যাত আপেক্ষিক গুরুত্বের সূত্র আবিস্কারের গল্পটি বহুল প্রচলিত। এই ঘটনার সূত্রে আর্কিমিডিসের উচ্চারিত ইউরেকা (Eureka- পেয়েছি) শব্দটি প্রবাদে পরিণত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
রাজা হিয়েরো এক স্বর্ণকারকে দিয়ে একটি সোনার মুকুট তৈরি করিয়েছিলেন। মুকুটটিতে খাদ মেশানো আছে কিনা তা নির্ণয় করবার জন্য তিনি আর্কিমিডিসকে অনুরোধ করেন।
একদিন টবে স্নান করতে গিয়ে আর্কিমিডিস লক্ষ করেন খানিকটা জল টবের গা বেয়ে উপচে পড়ে গেল।
এই ব্যাপারটা থেকেই আকস্মিকভাবে রাজার প্রশ্নের উপযুক্ত সমাধান তাঁর মাথায় এসে গেল। আনন্দে তিনি ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠলেন।
পরে একটি পরীক্ষার দ্বারা তিনি রাজাকে বুঝিয়ে দেন যে মুকুটটিতে খাদ মেশানো আছে।
সামান্য এই ঘটনার সূত্র ধরেই আর্কিমিডিস আবিষ্কার করেন আপেক্ষিক গুরুত্বের ভৌতিক সূত্র যা বিজ্ঞানে আর্কিমিডিসের তত্ত্ব নামে পরিচিত।
এই তত্ত্বে তার সিদ্ধান্ত হল ও অদ্রাব্য কোন বস্তুকে কোন স্থির তরল বা বায়বীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করলে, বস্তুটি সম-আয়তন জল বা বায়ু অপসারিত করে এবং নিজে অপসারিত জল বা বায়বীয় পদার্থের ওজনের সমান ওজন হারায়।
আর্কিমিডিস সোনার মুকুটে খাদের পরিমাণ নির্ণয় করেছিলেন এভবে, মুকুটের সমান ওজনের একটু সোনা তিনি একটি জলপূর্ণ পাত্রের মধ্যে ফেলে দেন। এর ফলে খানিকটা জল উপচে পড়ে এবং এই জলটুকু তিনি ওজন করেন। পরের বারে সোনার মুকুটটিকে তিনি জলভর্তি পাত্রে ফেলে দেন। এবারেও উপচে পড়া জলটুকু ওজন করেন।
দেখা যায় প্রথম ও দ্বিতীয়বারে উপচে পড়া জলের ওজন বিভিন্ন। এই থেকে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন মুকুট খাঁটি সোনার তৈরি হলে দুই বারেই ঠিক একই পরিমাণ জল উপচে পড়তো।
কিন্তু খাদ মেশানো থাকায় সমান ওজনের সোনা অপেক্ষা মুকুট আয়তনে কিছুটা বড় হয়েছে এবং তার ফলে জল খানিকটা বেশি ফেলে দিয়েছে।
কী পরিমাণ খাদ মুকুটে মেশানো হয়েছিল দুবারের জলের ওজনের পার্থক্য থেকেই তা নির্ণয় করা হয়েছিল।
আর্কিমিডিস বিজ্ঞানের বড় বড় জটিল তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতেন। রাজা হিয়েরোর অনুরোধে তিনি জনসমাজের কল্যাণকর যেসব ছোটখাট যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তার মধ্যে পুলি বা কপিকল এবং লিভার অন্যতম। এগুলোর সাহায্যে স্টীমারে জাহাজে নৌকায় রেলগাড়িতে ও বড় বড় কারখানায় মাল ওঠানো নামানো এবং খুব ভারি জিনিসকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাবার কাজ খুবই সহজভাবে করা যায়।