সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর লেখার মধ্যেও পরিবর্তন আসছিল। তিনি হয়ে উঠছিলেন সাধারণ মানুষের কবি, শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষের কবি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল সমস্ত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক।
১৯৪৮ সালে চিলির প্রেসিডেন্ট ভিদেলার সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন। প্রেসিডেন্ট ভিদেলা ছিলেন স্বৈরাচারী মনোভাবের মানুষ। কমিউনিজমের প্রতি তার ছিল তীব্র ঘৃণা। ইউরোপের বহু দেশের সাথে সম্পর্ক ছেদ করলেন। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ পেয়ে পালিয়ে গেলেন নেরুদা। এই সময় তাঁর সঙ্গী ছিল স্ত্রী দলিয়া। কোথাও বেশি দিন থাকতে পারেন না। এক শহর থেকে আরেক শহরে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন। শেষে সীমান্ত পেরিয়ে আর্জেন্টিনায় এসে আত্মগোপন করেন। দলিয়া শুধু যে তার সঙ্গী ছিলেন তাই নয়, সর্ব কাজে ছিলেন প্রধান প্রেরণা। এই স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবনেও তাঁর কলম স্তব্ধ থাকেনি। এই পর্যায়ে লেখা ছোট ছোট কবিতাগুলো হাজার হাজার মানুষের মুখে মন্ত্রের মত উচ্চারিত হত।
পলাতক জীবনে কবির পরিচয় হয় চিলির এক তরুণীর সাথে। দুজনের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল নিবিড় সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে ঘিরেই বিবাদ দেখা দিল দলিয়ার সাথে। দীর্ঘ ১৬ বছরের বিবাহিত জীবনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।
চিলির রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তনের ছোঁওয়া আসছিল। নেরুদা চিলিতে এসে স্থানীয়ভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। সমুদ্রের ধারে একটি বাড়ি করলেন। মাঝে মাঝে একাই বেরিয়ে পড়তেন। মাইলের পর মাইল বেলাভূমিতে বেড়াতে বেড়াতে ঝিনুক কুড়োতেন। জেলেদের সাথে গল্প করতেন। সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ শুনতে শুনতে কবিতা লিখতেন। ছোট ছোট সাধারণ বস্তুই হয়ে উঠেছিল তাঁর কবিতার বিষয়। তাতে কোন আড়ম্বর নেই, আবেগ নেই, অংহকার মুষ্টিমেয় মানুষের গণ্ডির সীমানা থেকে নিয়ে যেতে চাইলেন বৃহত্তর মানব সমাজের কাছে। শুধু চিলি বা স্পেন নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনূদিত হল তাঁর কবিতা।
ডাক এল ইউরোপ থেকে গেলেন রাশিয়া, জার্মানী, ফ্রান্স, ইতালি, ইংলন্ড। সর্বত্র পেলেন অভূতপূর্ব সম্মান আর সংবর্ধনা। রাশিয়া থেকে তাঁকে দেওয়া হল স্টালিন পুরস্কার। দেশে ফিরে আসবার এক বছর পর প্রকাশিত হল পর দুটি কাব্যগ্রন্থ জেনারেল সঙ (১৯৫৪), এলিমেন্টাল ওডস (১৯৫৪)। নেরুদা হয়ে উঠলেন চিলির জাতীয় কবি।
কবিতার মতই কবির জীবনে এল মাতিলদে উরুতিয়া। গভীর প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেলেন। জীবনের মধ্য পর্বে আসা এই প্রেমের আবেগে দীর্ঘদিন পর পর আবার প্রেমের কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হল “একশ প্রেমের সনেট” {one hundred love sonnets)। এই কবিতাগুলোর মধ্যে আত্মমগ্নতার সুর প্রবল হয়ে উঠেছে। তারই সাথে মাতিলদে ছিল তাঁর স্ত্রী, সহযোগী, সহকর্মী।
জীবনে খ্যাতি, ঐশ্বর্য, অর্থ, সম্মান, সুখ পেয়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি কবি। আত্মজীবনী Isla Negra তে লিখেছেন ছেলেবেলার কথা, চেনাজানা মানুষদের কথা, তেমুকোর কথা যেখানে বৃষ্টির জন্ম হয়। অহল্যাভূমিতে মানুষ কাজ করে, গাছের পাতায় পাতায় শোনা যায় বৃষ্টির শব্দ। গদ্যের ভাষা এখানে কবিতার মতই ছন্দময় হয়ে উঠেছে।
১৯৬৯ সালে আবার সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনীতি আর সংগ্রামই মানুষের মুক্তির পথ। একটি কবিতায় লিখেছেন
“আমাদের সকলেই ঐ এক লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য ব্যাকুল।
তিক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমরা অর্জন করব দুঃখ-যন্ত্রণার শেষ দিনটি।
সেটিই হবে আমাদের প্রতিপক্ষের বিচারের দিন।
হে আমার সংগ্রামী মৃত ভাইয়ের দল,
স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বানে
তোমরা যেদিন জেগে উঠবে
মৃত্যুর থেকেই ভেসে উঠবে
তোমাদের কণ্ঠস্বর।”
১৯৭০ সালে চিলির রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার জন্য নির্বাচনে অংশ নিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির তরফে জোরালো প্রচার শুরু হল। বামপন্থী দলের হয়ে একই সাথে নির্বাচনে নামলেন সালভাদার আলেন্দে (Salvador Allende)। আলেন্দ ছিলেন নেরুদার বন্ধু। আলেন্দের প্রতি নেরুদার ছিল গভীর শ্রদ্ধা। বন্ধুর সপক্ষে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে চিলির প্রেসিডেন্ট হলেন আলেন্দ। শুরু হল এক নতুন যুগ।
নেরুদা রাষ্ট্রদূত হয়ে গেলেন ফ্রান্সে। এক বছর পরেই তার অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল (১৯৭১)। চিলির জনগণের পক্ষ থেকে তাঁকে গণ সংবর্ধনা দেওয়া হল। স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল নেরুদার। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। পরীক্ষায় জানা গেল তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত সব কাজ থেকে অবসর নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের বাড়িতে।
চিলির ভাগাকাশে তখন বিপর্যয় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমেরিকান সামাজ্যবাদী শক্তি ষড়যন্ত্র শুরু করল। কিভাবে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা যায়। শুরু হল দেশ জুড়ে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। অসুস্থ নেরুদার কলম শাণিত হয়ে ওঠে। তিনি লেখেন, “আমি কোন সমালোচক বা প্রবন্ধকার নই, আমি সাধারণ এক কবি। তবুও কখনো এমন সময় আসে যখন আমাকে কিছু বলতেই হয়, বিশেষত আর সকলে যখন নীরব হয়ে থাকে, আমি চিৎকার করে দেখিয়ে দিই সেই শত্রুদের যারা যুদ্ধ চায়, যুদ্ধের আগুনে ধ্বংস করে মানুষের সৃষ্টিকে।”