ছেলেবেলাতে দেখা তেমুকোর অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সেই বনভূমি নির্জন প্রকৃতি আর নেই, সেখানে গড়ে উঠেছে শহর, কত অসংখ্য মানুষের আবাসস্থল। এখানকার মানুষের সাথে বহুদিন কোন যোগাযোগ নেই। নিজেকে যেন পরবাসী বলে। মনে হয়। মাঝে মাঝে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। অরণ্য মুক্ত প্রান্তর তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। সংসারে মারিয়ার সাথে অশান্তি বেড়ে চলে। দুজনেই বুঝতে পারেন এই ভাবে আর একসাথে থাকা সম্ভব নয়। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের।
এই মানসিক উদ্বেলতার মধ্যেই তিনি প্রকাশ করেন তার রেসিডেন্স অন আর্থ।’ এই পর্যায়ের সমস্ত কবিতাই লিখেছিলেন দূর প্রাচ্যে থাকাকালীন সময়ে। রেসিডেন্স অন আর্থ’ প্রকাশের সাথে সাথে চারদিক থেকে অভিনন্দন আসতে থাকে। সেই সূত্রেই একদিন পরিচয় হল আর্জেন্টিনার তরুণী চিত্রশিল্পী দলিয়ার সাথে। দুজনেই দুজনের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন। অল্পদিনের মধ্যেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তারা।
কবি হিসাবে খ্যাতি পেলেও আশানুরূপ অর্থ পেলেন না। নিতান্ত প্রয়োজনেই আবার বিদেশ দপ্তরে চাকরি নিলেন নেরুদা। এবার স্পেন। ১৯৩৪ সালে চিলির কন্সাল হয়ে এলেন স্পেনের বার্সিলোনায়। স্পেনের মানুষের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেলেন তিনি। এখানকার মানুষের মুখের ভাষাই তাঁর সাহিত্যের ভাষা। অল্পদিনের মধ্যেই তরুণ কবিদের সাথে পরিচয় হল। শুধু কবিতাই নয়, স্পেনের বুদ্ধিজীবীরাও স্বাগত জানাল এই তরুণ কবিকে। স্পেনের সমকালীন রাজনীতি, গণমুখী সাহিত্য গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল নেরুদাকে। তারই ফলশ্রুতি রেসিডেন্স অন আর্থের দ্বিতীয় পর্ব। সমস্ত স্পেনের সাহিত্য জগতে আলোড়ন ওঠে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অবশেষে প্রতিষ্ঠা পেলেন নেরুদা।
প্রথমে বার্সিলোনা তারপর মাদ্রিদে এলেন। মাদ্রিদ সেই সময় স্পেনের কবি শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকারদের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এদের অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল নেরুদার। স্পেনের ভাগ্যাকাশে তখন আবির্ভাব ঘটেছে স্বৈরাচারী শাসক ফ্রাংকোর। অল্পদিনের মধ্যেই দেশ জুড়ে শুরু হল গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬–১৯৩৯)। ফ্রাংকো উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ করলেন। চারদিকে প্রতিবাদের ঢেউ উঠল। সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবার জন্য শত শত মানুষকে হত্যা করা হল। এদের মধ্যে ছিলেন স্পেনের তরুণ কবি লরকা। বেদনায় ক্ষোভে ফেটে পড়লেন নেরুদা। তাঁর কবিতা হয়ে উঠল স্পেনের সংগ্রামী মানুষের প্রতিবাদের হাতিয়ার। সরকার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি জ্বালাময়ী ভাষায় প্রতিবাদ জানালেন।
স্পেনের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেরুদা গোপনে যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এই সময় লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা “Spain in my Heark” (1937}। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ায় তিনি সরকারের বিরাগভাজন হলেন। তাঁকে সরকারী কনসালের পদ হারাতে হল। চিলির রাজনৈতিক পরিবেশও আর তাঁর পক্ষে নিরাপদ ছিল না। স্ত্রী দালিয়াও সন্তানসম্ভবা। নেরুদা প্রথমে স্পেন ত্যাগ করে এলেন প্যারিসে। তারপর ফিরে এলেন চিলিতে।
চিলিতে এসেও রাজনৈতিক আন্দোলনের থেকে নিজেকে নিবৃত করলেন না। জোরালো ভাষায় স্পেনের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। দেশে দেশে সংগ্রামী মানুষদের কাছে প্রচার করতে থাকেন তাঁর রচনা। এই সময় তাঁর রচিত কবিতা সংকলন দ্য ফিউরাস অ্যান্ড দ্য পেইনস প্রকাশিত হয়। প্রথম যৌবনে তিনি লিখেছিলেন প্রেমের কবিতা, ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন সংগ্রামের কবি।
আমি যখন প্রেমের কবিতা লিখি,
আমার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে
ঝর্ণার মত কবিতার ধারা…
……………………।
ওরা আমাকে বলেছে, “কি মহান তুমি থিওকরিটাস।”
আমি বলেছি, আমি থিওকরিটাস নই।
জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে পেয়েছি,
জয় করেছি, চুম্বন করেছি।
তারপর প্রবাহিত মানুষের জীবনের
মুখোমুখি হওয়ার জন্য
হেঁটে গিয়েছি
পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে, খনির গুহাগর্ভে।
দু বছর কর্মহীন জীবন যাপন করবার পর ১৯৪০ সালে কনসাল জেনারেল হিসাবে তাঁকে পাঠানো হল মেক্সিকোতে। দীর্ঘ তিন বছর তিনি মেক্সিকোতে ছিলেন। এই সময় নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন। চিলির রাজনৈতিক জগতের অনেকের সাথেই যোগাযোগ রাখতেন।
চিলিতে তখন চলেছে পালা বদলের পালা। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এলেন চিলিতে। অর্থের অভাব নেই। বই বিক্রি বাবদ নিয়মিত অর্থ পাচ্ছেন। বহুদিন ধরে ইচ্ছে ছিল বৈচিত্র্যময় দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণ করবেন। বেশ কয়েক মাস ধরে ঘুরে বেড়ালেন বিভিন্ন দেশে। অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতেন প্রকৃতির ব্যাপ্ত বৈচিত্র্য। পেরুতে এক রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখে লিখলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা The Heights of Macchu Picchu. শুধু প্রকৃতি নয়, দেখলেন দক্ষিণ আমেরিকায় বঞ্চিত শোষিত মানুষদের। তাঁর মনে হত এই মানুষদের মুক্তির কথা।
চিলিতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে। নেরুদা বিশ্বাস করতেন একমাত্র মার্কসবাদই পারে শোষণ বঞ্চনা থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করতে। (১৯৪৫) নেরুদা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলেন। সেই সময় চিলির আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। নেরুদা নির্বাচনে দাঁড়ালেন। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে সিনেটের সদস্য নির্বাচিত হলেন। এর পরেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন। এবং আমৃত্যু তিনি এই পার্টির সভ্য ছিলেন।