তেমুকোর পরিবেশ সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুকূল ছিল না। নেরুদার পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে যেন সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অগ্রণী পুরুষ হয়ে ওঠে। তাই ষোল বছর বয়েসে নেরুদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল শান্তিয়াগোতে। সেই সময় কিশোর কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নেরুদা। তাঁর সাহিত্য জীবনে স্থানীয় মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের ভূমিকা বিরাট। মিস্ত্রাল শুধু চিলির নন, বিশ্বসাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টির জন্য নোবেল পুরস্কার পান। মিস্ত্রাল নেরুদার মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ কবির সম্ভাবনাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি শুধু তাঁকে উৎসাহিত করতেন তাই নয়, নিয়মিত তার কবিতা সংশোধন করে দিতেন।
১৯২১ সালে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নেরুদা এলেন সান্তিয়াগোতে। চিলির অন্যতম প্রধান শহর। সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। এখানে এসে ফরাসী ভাষা শিখতে আরম্ভ করলেন। কলেজে ভর্তি হলেন কিন্তু পড়াশুনায় তেমন মন নেই। কেমন ছন্নছাড়া ভাব। অল্পদিনের মধ্যেই কয়েকজন তরুণ কবির সাথে পরিচিত হলেন। তার কবিতা তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে আরম্ভ হয়েছে। এই সময়েই তিনি পিতৃ নাম পরিত্যাগ করে পাবলো নেরুদা”–এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন।
কবি হিসাবে যখন সাহিত্যরসিকদের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, নেরুদার জীবনে এল এক সুন্দরী তরুণী আলবার্তিনা। দীর্ঘ দিন তার পরিচয় গোপন রেখেছিলেন নেরুদা। প্রথম প্রেমের মুকুল বিকশিত হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনের সম্পর্কে ভাঙন ধরল। জীবন থেকে হারিয়ে গেলে ও আলবার্তিনাকে কবি অমর করে রেখেছেন তার অসাধারণ সব প্রেমের কবিতায়। এই কবিতাগুলো নিয়ে ১৯২৪ সালে কুড়ি বছর বয়েসে প্রকাশিত হল Twenty Love poenns. এর আগে আর একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন Twilight Book. সেই বইটি তেমন কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু “কুড়িটি প্রেমের কবিতা” বইটি প্রকাশিত হতেই চারদিকে আলোড়ন পড়ে গেল। প্রচলিত ধারাকে অনুসরণ করলেও এর আঙ্গিক, ভাব, ভাষায় নিয়ে এলেন পরিবর্তন। আনন্দ-বেদনার সুরের মূচ্ছনা এতে এমনভাবে পরিস্ফুট হয়েছে সহজেই পাঠকের অন্তরকে স্পর্শ করে কবি হিসাবে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
১৯২৬ সালে প্রকাশিত হল দুটি রচনা। এক বন্ধুর সাথে যৌথভাবে একটি ছোট উপন্যাস। আর একটি কবিতার বই Venture of Infinite man-এর প্রতিটি কবিতায় প্রচলিত সমস্ত প্রথা ভেঙে নিয়ে এলেন নতুন আঙ্গিক, ছন্দ। মানব চরিত্রের এক অস্থিরতা, নিঃসঙ্গতাই এখানে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এই বইটিকে গ্রহণ করতে পারল না।
এদিকে ছেলে পড়াশুনা বন্ধ করে কবিতা লিখছে এই ব্যাপারটি ভাল লাগল না নেরুদার বাবার। তিনি সমস্ত মাসোহারা বন্ধ করে দিলেন। মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন নেরুদা। তিনটি বই বার হলেও তার থেকে সামান্যই অর্থ পেয়েছেন। অর্থ ছাড়া কেমন করে নিজের খরচ মেটাবেন! পিতার কাছে হাত পাততে মন সায় দিল না। শুরু হল চাকরির চেষ্টা। কয়েক মাস চেষ্টা করেও কোথাও চাকরি পেলেন না। সেই সময় চিলির বিদেশ দপ্তর থেকে রেঙ্গুন অফিসে পাঠাবার জন্যে একজন লোকের খোঁজ করা হচ্ছিল। কোন লোকই কয়েক হাজার মাইল দূরে বার্মার রেঙ্গুন তখন ব্রিটিশ অধিনস্ত বার্মার রাজধানী। এখানে পরিচিত কোন মানুষ নেই। স্থানীয় মানুষেরা কেউ স্প্যানিশ ভাষা জানে না। অফিসের দু-চারজন যেটুকু ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ জানে তাতেই কোন রকমে কথাবার্তা চালান। অসহনীয় পরিবেশ, কথা বলবার লোক নেই, তার উপর সব মাসে ঠিক মত মাইনে পান না, তবুও রেঙ্গুনে রয়ে গেলেন। এই নির্জন প্রবাসে তার একমাত্র সঙ্গী কবিতা।
চার বছর কেটে গেল। স্থানীয় ভাষা মোটামুটি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন নেরুদা। অনেক বার্মিজ পরিবারের লোকজনের সাথেই তার আলাপ পরিচয় ছিল। এদের মধ্যে ছিল এক তরুণী। তার মধ্যেকার উদ্দামতা দেখে ভাল লেগে গিয়েছিল। প্রেমে পড়ে গেলেন। কিছু দিন যেতেই নেরুদা অনুভব করলেন মেয়েটির মধ্যে আছে এক আদিম বন্য উদ্দামতা। মনের মধ্যে যদি কখনো সন্দেহ দেখা দেয়, সাথে সাথে ছুরি দিয়ে হত্যা করবে নেরুদাকে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন নেরুদা। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় সিংহলে তার বদলির আদেশ হল। কাউকে কিছু না জানিয়ে রওনা হলেন সিংহল। মেয়েটি নেরুদার সন্ধান পাওয়ার জন্যে সিংহল পর্যন্ত গিয়েছিল। তার এই বন্য প্রেমকে নেরুদা বহু কবিতায় অবিস্মরণীয় রূপ দিয়েছেন। বার্মার জীবনের নিঃসঙ্গতাকে ভুলতে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। এই কবিতাগুলো সংকলন করেই পরে প্রকাশিত হয় তার একটি। বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ Residence on eath (পৃথিবীতে বাসা)।
সিংহলে অল্প কিছুদিন থাকার পর এলেন বাটাভিয়ায় প্রবাস জীবনে একাধিক মেয়ের সান্নিধ্যে এলেও কাউকে বিবাহ করবার কথা ভাবেননি। বাটাভিয়াতে প্রথম ডাচ তরুণী মারিয়া এন্তোনিয়েতাকে দেখে বিবাহ করার কথা মনে হল। একদিন সরাসরি মারিয়াকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। সম্মত হল মারিয়া। প্রথম কয়েক মাস সুখেই কেটে গেল। মারিয়া ডাচ মেয়ে, স্প্যানিশ ভাষা জানত না। নেরুদার চেষ্টা সত্ত্বেও স্প্যানিশ ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তার সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। নেরুদার কবিতার ব্যাপারেও ছিল উদাসীন। দুজনের মধ্যেকার মতাদর্শগত পার্থক্য, দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। বাটাভিয়াতে থাকতে মন চাইল না, ফিরে এলেন তেমুকোতে বাবার কাছে।