রোলাঁ যখন এই মতবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন তখন তিনি ৭০ বছরের বৃদ্ধা। শুরু হল চারদিকে প্রচার-রোলাঁ কমিউনিস্ট…দেশদ্রোহী।
কিন্তু নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত রোলাঁ শুধু ইউরোপ নয়, সমস্ত মানবের মুক্তির কামনায় মুখর হয়ে উঠলেন। “ভারতবর্ষ, চীন ইন্দোচীন প্রভৃতি শোষিত নিপীড়িত জাতির পাশে দাঁড়িয়ে আমি যুদ্ধ করব।”
১৯৩৬ সালে রোলাঁর ৭০তম জন্মদিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আড়ম্বর করে পালন করা হল। তাকে বলা হল ফ্রান্সের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান, মানব কল্যাণের এক অক্লান্ত যোদ্ধা।
জার্মাণির বুকে তখন শুরু হয়েছে হিটলারের তাণ্ডব। রোলাঁ অনুভব করতে পারছিলেন আগামী দিন ইউরোপের বুকে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় নেমে আসছে।
১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করল। শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪০ সালে জার্মানরা ফ্রান্স দখল করল। রোলাঁ রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, সেটাই তাঁর শেষ চিঠি।
“আমি সংবাদপত্রে লিখতে পারছি না…তাই যৌবনের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলোকে আমি পুনরায় জীবন্ত করে তুলছি, স্মৃতিকথা লিখছি।
অন্ধ হিংসা ও মিথ্যায় উন্মত্ত এই পৃথিবীতে আমাদের সত্য ও শান্তিকে রক্ষা করতেই হবে।”
রোলাঁ জীবনের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও নিজের গৃহ ছেড়ে কোথাও যাননি। তার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হত। তাঁর প্রতিটি চিঠি পরীক্ষা করা হত, এমনকি তাঁকে খুনের হুমকি অবধি দেওয়া হত।
নিজের জন্যে কখনো চিন্তিত ছিলেন না রোলাঁ। মানুষের এই হত্যা নির্যাতন তাঁকে সবচেয়ে ব্যথিত করত। তাঁর মনে হত গ্যেটে বিঠোফেনের মহান দেশের এ অধঃপতন। একি সভ্যতার আসন্ন মৃত্যু!
এক বেদনার্ত হৃদয়ে নিঃসঙ্গভাবে সারাদিন নিজের ঘরে বসে থাকতেন। নিজেকে প্রকাশ করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। চারদিকে অনাহার অভাব। জার্মান দূতাবাস তাঁকে সব কিছু দিতে চেয়েছিল, খাদ্য, কয়লা, পোশাক। কিন্তু হত্যাকারীর হাত থেকে কিছু গ্রহণ করতে তাঁর বিবেক বাধা দিয়েছিল। তাই জার্মানদের সমস্ত দানকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
অবশেষে ১৯৪৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ৭৮ বছর বয়সে যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তেও বিশ্বাস হারাননি। নতুন যুগের মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছেন–
“নতুন দিনের মানুষ, হে তরুণের দল, আমাদের পদদলিত করে তোমরা এগিয়ে চল। আমাদের চেয়েও বড় ও সুখী হও।”
৮৬. পাবলো নেরুদা (১৯০৪–১৯৭৩)
“আমি কোন সমালোচক প্রবন্ধকার নই। আমি সাধারণ কবি মাত্র। কবিতা ভিন্ন অন্য ভাষায় কথা বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা কর আমার কবিতা কি? তাহলে বলতে হয় আমি জানি না। কিন্তু যদি আমার কবিতাকে প্রশ্ন কর সে জবাব দেবে, আমি কে।”
যথার্থ অর্থেই তাঁর কবিতার মধ্যেই তার জীবনের প্রকাশ। তাঁর কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে তার ভালবাসা, তাঁর আশা আকাক্ষা, স্বপ্ন-আবেগ, তার আনন্দ, বেদনা, ক্রোধ, হতাশা আর সকলকে ছাপিয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদের কবি, ভালবাসার কবির নাম পাবলো নেরুদা।
নেরুদার আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেয়েজ বোসোয়ালতো। কিশোর বয়েসে যখন নেরুদার সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত হয়, সেই সময় চেকোশ্লোভাকিয়ায় ইয়ান নেরুদা বলে একজন বিখ্যাত লেখক ছিলেন। তাঁর নামে ছদ্মনাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন পাবলো নেরুদা।
নেরুদার জন্ম চিলিতে (১২ জুলাই ১৯০৪)। দক্ষিণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে স্বাধীন দেশ চিলি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী মানুষ আর স্থানীয় উপজাতিরাই গড়ে তুলেছে এই দেশ। এখানে মিশ্র-ভাষা গড়ে উঠলেই সাহিত্যের ভাষা স্প্যানিশ। নেরুদার বাবা ছিলেন সামান্য কিছু জমির মালিক, মা একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। নেরুদার জন্মের এক মাস পরেই মা টি. বি. তে মারা যান। বাবা আবার বিয়ে করলেন। নিজের মা না হলেও সৎ মা নেরুদাকে ভালবাসতেন নিজের সন্তানের মত। নিজের সন্তানের সাথে কোনদিন বিভেদ করেননি সৎ মা।
নেরুদার বয়স তখন দু বছর। দক্ষিণ চিলির সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গল কেটে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। সংসারের আর্থিক অনটনের জন্য নেরুদার বাবা স্থির করলেন আরাউকো প্রদেশের সেই অরণ্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করবেন। সেখানে রেললাইন সংলগ্ন কাজ, রাস্তা তৈরির ঠিকাদারির কাজ নিলেন।
এ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। চারদিকে ঘন সবুজ অরণ্য। কোথাও অরণ্য নির্মূল করে গড়ে উঠেছে চাষের ক্ষেত। সর্বত্রই এক আদিম বন্য প্রকৃতি। কোন ধর্মীয়, সামজিক নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল নেই। মুক্ত অরণ্যের মতই মানুষের বেড়ে ওঠা। অরণ্যের নিত্য সঙ্গী হয়ে সারা বছর ঝরে পড়ে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। শিশু নেরুদার জীবনে এই বৃষ্টি আর অরণ্য গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সকলের অজান্তেই তার মধ্যে জেগে উঠেছিল এক কবি স্বত্তা। যখন তার বয়স মাত্র দশ। তখনই শুরু হয় তাঁর কবিতা লেখা। শিশুমনের কল্পনায় যে ভাব জেগে ওঠে তাই লিখে ফেলেন।
স্কুলে নিয়মিত পড়াশুনার সাথে সাথে বাইরের বই পড়ার নেশা জেগে ওঠে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ছেলেবেলায় আমি ছিলাম ঠিক যেন এক উটপাখি। কোন কিছু বাজবিচার না করেই আমি যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম।