যুদ্ধের শেষে রোলাঁ রচনা করলেন Declaration of Indipendence of the Mind (মানবাত্মার স্বাধীনতার ঘোষণা)। এতে ইউরোপের বহু মনীষী স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারতবর্ষের রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন রোলাঁ যদিও তখনো তাঁদের মধ্যে পরিচয় হয়নি।
ভারতবর্ষ থেকে স্বাক্ষর করলেন রবীন্দ্রনাথ ও আনন্দকুমার স্বামী।
যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন রোলাঁ। তার মনে হয় এর থেকে মুক্তির পথ কোথায়? গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন প্রাচ্যের মহান আদর্শে।
যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যখন চারদিক থেকে ঘৃণিত নিন্দিত তখনই প্রথম ভারতীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। অজস্র বই পড়েন ভারতীয় দর্শন ধর্ম সংস্কৃতি সম্বন্ধে। যুদ্ধের পরবর্তীকালে রোলাঁর সাথে সাক্ষাৎ হল রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করলেন ভারত-আত্মার মূর্ত বাণীকে। দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। যা আমৃত্যু বজায় ছিল।
তবে যিনি ভারতবর্ষের এক পূর্ণাঙ্গ ছবি রোলাঁর কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি দিলীপকুমার রায়। দিলীপ রায়ের কাছেই রোলাঁ প্রথম গান্ধীর কথা শোনেন। তারপর লিখলেন গান্ধীর জীবনী। তিনি লিখলেন, “আমি অনুভব করছিলাম ইউরোপের বুকে ঝড়ের পূর্বাভাস। নিজের জন্য আমি চিন্তিত নই। জীবনের প্রান্তসীমায় এসে আশ্রয় খুঁজেছি আমার প্রিয়জনদের জন্যে, ইউরোপের মানুষের জন্যে। এই সময় দেখতে পেলাম ভারতের বুকে জীর্ণ শীর্ণ দেহ একটি মানুষ আত্মিক বলের ঝড় তুলেছেন…যে আদর্শ সেই সময় আমার মনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল তা গান্ধীর।” ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হল গান্ধীচরিত।
রোলাঁ গান্ধীর প্রতি এতখানি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার কারণ গান্ধী যা চেয়েছিলেন তাই তিনি করতে পেরেছিলেন। তাই রোলাঁ বলেছেন তলস্তয় যেখানে ব্যর্থ গান্ধী সেখানে সফল।
এর পরবর্তীকালে তিনি আকৃষ্ট হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রতি। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত হল তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের জীবনী। রামকৃষ্ণের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন অধ্যাত্ম সাধনা আর মানব প্রেমের এক সম্মিলিত রূপ। বিবেকানন্দের মধ্যে পেয়েছিলেন তার কর্মের বাণী।
একদিন যখন রোলাঁ প্রাচ্যের ধ্যানে মগ্ন, অন্যদিকে তখন তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন যুদ্ধরোত্তর ইউরোপের এক জীবন্ত চিত্র ‘বিমুগ্ধ আত্মা’ উপন্যাসে। এর প্রথম দুই খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে, তৃতীয় খণ্ড ১৯২৬, চতুর্থ ১৯৩৩।
‘বিমুগ্ধ আত্মা’ রোলাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা জা ক্রিসতফে রোলাঁ পূর্ণতা পাননি কিন্তু বিমুগ্ধ আত্মাতে এসে পেলেন পূর্ণতা। এই উপন্যাস জঁ ক্রিসতফের চেয়ে অনেক পরিণত।
এই কাহিনীর নায়িকা আনেৎ। সে এক শিল্পীর কন্যা। সুন্দরী, ধনী পরিবারে তার বিয়ে স্থির হল। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্বে তার প্রেমিক বিয়ের মানসিকতার সাথে একমত হতে পারল না। আসলে সে চেয়েছিল স্বাধীনতা। পূর্ণ নারীতু। স্ত্রী হিসাবে দাসত্ব নয়। তখন সে সন্তানসম্ভবা। সন্তানের কথা ভেবেও সে বিয়ে করল না। নিজের সন্তান মার্ককে নিয়ে শুরু হল তার জীবন সংগ্রাম। আনেৎ যেন চিরন্তন নারী সংগ্রামের প্রতীক। দেশে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। তারই মধ্যে আনেৎ দেখেছে মানুষের কদর্য রূপ। অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। আনেৎ নতুন যুগের স্বপ্ন দেখে। তার বিশ্বাস একদিন এই অন্ধকার পৃথিবী থেকে মানুষের সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই উত্তরণ ঘটবে। এই উপন্যাস শেষ হয়েছে সেই সংগ্রামের ডাক দিয়ে। “ন্যায়পরায়ণ হওয়া তো ভাল কিন্তু প্রকৃত ন্যায়বিচার কি শুধু দাঁড়িপাল্লার কাছে বসে থাকে, আর দেখেই সন্তুষ্ট হয়? তাকে বিচার করতে দাও, সে হানুক আঘাত। স্বপ্ন তো যথেষ্ট দেখেছি আমরা, এবার আসুক জাগার পালা।”
১৯১৯ থেকে ১৯২৯ রোলাঁর জীবনের এক যুগসন্ধিক্ষণ। একদিকে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা অন্যদিকে বাস্তব পৃথিবীর হাজার সমস্যা। ইউরোপের বুকে নতুন চিন্তা ভাবনার উন্মেষ। তিনি উপলব্ধি করলেন গান্ধীবাদের আদর্শ যাকে একদিন তার মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীকে পথ দেখাবে, ক্রমশই তার রং যেন ফিকে হয়ে আসছে।
ইউরোপের বুকে তখন ঘটে গিয়েছে রুশ বিপ্লব। এই নতুন আদর্শকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও তাকে মেনে নিতে পারেনি তিনি। তার অন্তরে তখন গান্ধী আর তলস্তয়।
রুশ সাহিত্যিক গোর্কির সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল রোলাঁর। গোর্কিই তাঁকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক মতবাদের সাথে পরিচিত করালেন। প্রথমে সোভিয়েত সরকারকে মেনে নিতে না পারলেও ক্রমশই তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৯২৯ সালে যখন ফ্রান্সে কমিউনিস্টদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল, তাদের বন্দী করা হল, শ্রমিক শ্ৰেণীর উপর শুরু হল নির্যাতন, সেই সময় ফ্রান্সের বিখ্যাত কয়েকজন কবি দার্শনিক লেখক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়লেন।
রোলাঁ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কোন পথে তিনি যাবেন! প্রথমে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি লেখক সাহিত্যিক, রাজনীতি তার ধর্ম নয়। কিন্তু শেষে অনুভব করলেন যখন মানব জাতি বিপন্ন তখন সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তিনি সমস্ত দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে নেমে এলেন রাজনীতির আঙিনায়, অনুভব করলেন মার্কসবাদের মধ্যেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিহিত। রচনা করলেন তাঁর “শিল্পীর নবজন্ম”। রোলাঁ লিখেছেন, “সমস্ত জীবন ধরে আমি যে পথের সন্ধান করেছি, সমাজতন্ত্রের মধ্যেই তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি।”