এর কয়েক বছর পর রোলাঁ আর একটি জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন–তলস্তয় (১৯১১)। এই সময়ে রোলাঁর মধ্যে অনেক পরিণতি এসে গিয়েছে। তাই তাঁর তলস্তয় অনেক পরিণত। যদিও তলস্তয়কে তিনি আদর্শ বলে গ্রহণ করেননি।
এই সব জীবনী গ্রন্থ রচনার আগে থেকেই তাঁর মন অন্বেষণ করছিল এক আদর্শ মানুষের, যে চিরসগ্রামী দুঃখের ভারে ভেঙে পড়ে কিন্তু নত হয় না। তাঁর মনের ভাবনা আদর্শের প্রকাশ ঘটল তার জগৎবিখ্যাত উপন্যাস জা ক্রিসফ-এ।
এই বইখানি লিখতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল রোলাঁর দশ বছর ধরে তিনি রচনা করেছেন তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস। প্রথম খণ্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে এবং শেষ খও বার হয় ১৯১২ সালে। এই সুদীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হলেও তার প্রতি জনগণের দৃষ্টি পড়েনি। এই বইয়ের মধ্যে ইউরোপের সমস্ত শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীদের আত্মা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
জা ক্রিসফ সঙ্গীতশিল্পী পরিবারের সন্তান। তাদের কুটিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর কলতান…পিয়ানোর সুর তাকে মুগ্ধ করে। সঙ্গীত যেন মেশায় রক্তের মধ্যে, সঙ্গীতচর্চার মধ্যেই ধীরে ধীরে। বড় হয়ে জাঁ ক্রিসফ কুড়ি বছর বয়সে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করল। কিন্তু বিপ্লব ব্যর্থ হল। ক্রিসফ এল ফ্রান্সে। এখানে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল লেখক অলিভিয়ের সাথে। ক্রিসফ চায় শিল্পের মধ্যে বেঁচে থাকতে। অলিভিয়ের মনে হয় শিল্প জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের আশ্রয়স্থল। এক অন্তর্দ্বন্দ্ব জেগে ওঠে ক্রিসতফের মনে। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব রোলাঁর মনোজগতেরই প্রতিচ্ছবি।
ক্রিসতফ সরল উদাসীন, সঙ্গীতই তার কাছে একমাত্র অস্তিত্ব। সব কিছুর মধ্যেই সে যেন সঙ্গীতকে খুঁজে বেড়ায়। আশাহত হয় কিন্তু বিশ্বাস হারার না।
বৃদ্ধ হয়ে পড়ে ক্রিসফ। অসুস্থ দেহ। সব শক্তি হারিয়ে ফেলে। তবু তার মনে হয় একদিন সে আবার ফিরে আসবে নতুন সংগ্রামের জন্য। জা ক্রিসতফের মধ্যে রোলাঁর আত্মাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে।
১৯১২ সাল অবধি রোল ছিলেন প্রায় অজ্ঞাত। নাটক জীবনী প্রবন্ধ কোন কিছুই তাকে খ্যাতি পারেনি। কিন্তু জা ক্রিসফ প্রকাশিত হতে না হতেই তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে ক্রিসতফের মধ্যে আবিষ্কার করল তাদেরই জীবনের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা।
ইউরোপের বুকে তখন নেমে এসেছে যুদ্ধের ঘনঘটা। ১৯১৪…শুরু হল বিশ্বযুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এই সময় ব্যক্তি রোলাঁর পরিচয় মুছে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন সমগ্র ইউরোপ তথা মানবজাতির বিবেকের প্রতিরূপ।
সমস্ত ইউরোপ জুড়ে যখন শুরু হয়েছে হানাহানি, হত্যা আর রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত আদর্শ, রোলাঁ তখন সুইজারল্যান্ডে। তখন তিনি আর কোন দেশের নন, সব দেশের সব মানুষের। রোলাঁ যোগ দিলেন আন্তজার্তিক রেডক্রসে। সৈনিকদের বাড়ি থেকে অসংখ্য চিঠি আসত সৈনিকদের সংবাদের জন্য। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংগ্রহ করতেন সৈনিকদের সংবাদ। প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা ধরে চিঠি লিখতেন।
রোলাঁর মনে হল এই মুহূর্তে শুধু সেবা নয়, সকলের আগে প্রয়োজন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হাওয়া। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি প্রকাশ করলেন “যুদ্ধের ঊর্ধ্বে। এই বই মুহূর্তে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি সৈনিকরাও এই বই পড়তে আরম্ভ করল। সাথে সাথে প্রথমে ফরাসী সরকার তারপর জার্মান সরকার এই বই নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু রোলাঁর কলম বন্ধ হল না। অবিশ্রান্তভাবে তিনি লিখে চললেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
ফ্রান্সের যুদ্ধবাজ মানুষেরা রোলাঁর এই মনোভাবের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠল। নিষিদ্ধ করা হল তার সমস্ত রচনা, তাকে বলা হল বিশ্বাসঘাতক, দেশের শত্রু জার্মানীর গুপ্তচর। তাঁর সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করল। রোলাঁ জানতেন সত্যের সপক্ষে লড়াই করতে গেলে তাকে আরো নির্যাতন সইতে হবে। তিনি এবার দেশে-বিদেশের মনীষীদের কাছে আবেদন জানালেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্যে। কিন্তু একমাত্র আইনস্টাইন ছাড়া কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। এই সময়কার দিনলিপিতে রোলাঁ লিখেছেন, “আমার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। আমি যদি মরে যেতাম তাহলে ভাল হত। মানুষ যখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তখন বাঁচার প্রয়োজন কি?”
আবার তারই নিজের আদর্শবাদে চিরবিশ্বাসী রোল লিখেছেন–”এক বছর ধরে আমি অনেক শত্রু সৃষ্টি করেছি। তারা আমাকে ঘৃণা করতে পারে কিন্তু কেউ আমার মনের মধ্যে অন্যের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে পারবে না। আমার কাজ যা কিছু শুভ মানবিক, তারই প্রচার করা। তা অন্যের ভাল লাগুক বা না লাগুক তাতে আমার কোন প্রয়োজন নেই।”
এমনকি রোলাঁ জার্মান লেখক বুদ্ধিজীবীদেরও চিঠি লিখেছিলেন কিন্তু কেউ তাঁর সপক্ষে দাঁড়ায়নি। শুধু সৃষ্টি হল অসংখ্য শত্রু।
এরই মধ্যে ১৯১৫ সালে রোলাঁকে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। রেডক্রসের কাজ করবার সময় অনুভব করেছিলেন তাদের অর্থের প্রয়োজন। নিজের প্রয়োজনের জন্য একটি কপর্দকও নেননি রোলাঁ। সমস্ত অর্থই তুলে দিলেন রেডক্রসের হাতে।
অবশেষে যুদ্ধ শেষ হল। বিজয়ীরা উল্লাসে ফেটে পড়ল। তাদের মত্ততা অহঙ্কার গর্বকে ভাল চোখে দেখেনি রোলাঁ। তাঁর মনে হয়েছিল এ ভবিষ্যৎ আরেক যুদ্ধের ইঙ্গিত।