অধ্যাপনার সাথে সাথে রোল অনুভব করতে চেষ্টা করতেন ফরাসী সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য শিল্পের মূল স্রোতধারা। কিন্তু যেদিকেই তাকাতেন, দেখতেন, সমস্ত সমাজ জুড়ে শুধু নিরাশা, হতাশা আর অবক্ষয়। ফরাসী সাহিত্যের সব দিকপাল স্রষ্টারাই চলে গিয়েছেন। যারা আছে তারা চটুল সাহিত্যের নেশায় ডুবে গিয়েছে। সমাজের সর্বত্র দুর্নীতি আর অনাচার। ফরাসী বিপ্লবের মহান আদর্শ বিলীন হয়ে গিয়েছে। সমাজের বুকে যে সব শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিক রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছেন হতাশার অন্ধকারে।
এরই মধ্যে আবির্ভাব হল কয়েকজন তরুণের যারা এই অন্ধকারের বুকে জ্বালাতে চান নতুন আলো।
তাদের প্রধান হলেন রোলাঁ, তাঁর সঙ্গী হলেন পেগী স্যুয়ারে। এরা সকলেই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, কারোরই আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তবুও সকলের মিলিত চেষ্টায় প্রকাশিত হল একটি পত্রিকা Cabiers de la guinzaine-রোলাঁ তার সম্পাদক। এই পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন দেওয়া হত না, বাজারে ফেরি করা হত না। আগ্রহশীল কিছু পাঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বিতরণ। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল রোলাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকটি রচনা–জা ক্রিস্তফ, বিঠোফেন, মিকেলেঞ্জলো–এই পত্রিকায় লেখার জন্য কখনো একটি পয়সাও নেননি। দীর্ঘ পনেরো বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই পত্রিকাটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
রোলাঁ ছেলেবেলায় সঙ্গীতের সাথে ভালবেসেছিলেন শেকস্পীয়রকে। পরিণত বয়েসে এসে অনুভব করতে পারছিলেন নাটকের গুরুত্ব। সমাজকে নাটক কিভাবে প্রভাবিত করতে পারে তারই ভাবনায় ১৮৯৫ থেকে ১৯০০ এই পাঁচ বছরে তিনি লিখলেন তিনটি নাটক– Saint Louis, Aert, Triomphe de la Raison। এই নাটকগুলোর বিষয়বস্তু ছিল সমাজ, জাতি ও মানুষদের উপর বিশ্বাস। এর উৎস ছিল ফরাসী বিপ্লব। এর পরে আরো কয়েকটি নাটক লিখলেন। এই নাকটগুলোর নাম ট্রাজেডিস অব ফেথ (Tragedies of Faith)।
কিন্তু ক্রমশই তিনি অনুভব করতে পারছিলেন তাঁর নাটকে যেন জনগণের প্রাণের স্পর্শ নেই। এ নাটক যেন শুধুমাত্র সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের জন্যে লেখা হয়েছে। তিনি স্থির করলেন এবার নাটক লিখবেন সাধারণ মানুষের জন্য, জনগণের জন্য। এক নতুন আদর্শের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করলেন তাঁর নাটক লেখা। তিনি এই পর্যায়ের নাটকের নাম দিলেন গণনাট্য (People’s Theatre)। লিখলেন, Les Loups (১৮৯৮), Lc0uatarze Jullet.এই পর্যায়ে তার শ্রেষ্ঠ নাটক ১৪ই জুলাই। এই নাটকে নায়ক ডাক দিয়েছে বাস্তিল দুর্গ ভেঙে ফেলবার। এ যেন ফরাসী বিপ্লবের ডাক নয়, এ যেন তৎকালীন সমাজের সমস্ত অবক্ষয়কে ভেঙে ফেলবার ডাক।
কিন্তু ফরাসী সমাজ তখন আফিমের নেশার মত এক আত্মতৃপ্তিতে ডুবে আছে। রোলাঁর উদাত্ত আহ্বান কারো কানে পৌঁছাল না। কোন নাটকই মঞ্চে সফল হল না। অল্প কয়েকদিন চলবার পরেই তা বন্ধ হয়ে গেল। এরই সাথে সমালোচকদের তীব্র সমালোচনা…রোলাঁর সমস্ত পরিশ্রম যেন ব্যর্থ হয় গেল। আসলে রোলাঁর নাটক এক একটি ভাব আদর্শের প্রতীক। সমাজের সাধারণ মানুষের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ তাতে স্থান পায়নি। তার দৃষ্টি ছিল আকাশের দিকে। মাটি সেখান থেকে অনেক দূর। তাই তার নাটক মাটির মানুষেরা গ্রহণ করতে পারেনি।
এই পরাজয়ে সাময়িক ভেঙে পড়লেও হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাবার মানুষ ছিলেন না রোলাঁ। অল্পদিনের মধ্যেই নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আসলে নিজের আদর্শের প্রতি রোলাঁর ছিল গভীর বিশ্বাস। কোন কারণেই সেই আদর্শ থেকে কখনো বঞ্চিত হননি।
এই সময় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে নেমে এল অশান্তির কালো মেঘ। বিবাহ করেছিলেন কিন্তু বিবাহ সুখের হয়নি। ১৯০৩ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গেল। ক্রমশই সমাজ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন রোলাঁ। আসলে মনের মধ্যে তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল নতুন সৃষ্টির প্রেরণা। কিন্তু সমস্যা হল কি লিখবেন! হঠাৎ মনে হল তিনি লিখবেন সেই সব মানুষদের কথা যারা সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বিশ্বাস হারাননি। যার ছিলেন অটল ধৈর্য আর সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। শুরু করলেন বিঠোফেন। এর ভূমিকায় লিখেছেন চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কর্ম আর নোংরা আবহাওয়ার মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সব জানলা খুলে দাও! স্বর্গীয় বাতাস এসে ভরে যাক ঘর-দুয়ার। মহান মানুষদের স্বর্গীয় বাতাসের স্পর্শে আমাদের বুক ভরে উঠুক।
রোলাঁ তাঁর এই জীবনী রচনায় এক নতুন আঙ্গিকের জন্ম দিলেন। শুধু সাল তারিখ আর তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। লেখকের ভাব ভাবনা অনুভূতিই এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার কাছে বিঠোফেন শুধু একজন মহান সঙ্গীতকার নন, তার চেয়েও অনেক বড়। যিনি সমস্ত জীবন দুঃখের মধ্যে, যন্ত্রণার মধ্যে অতিবাহিত করেও সব দুঃখ-যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন। বিঠোফেন প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে।
এরপর রচনা করলেন মিকেলেঞ্জলো (১৯০৬)। সেই সময়ের যুগকে ছবির মত করেই ফুটিয়ে তুলেছেন রোলাঁ। মিকেলেঞ্জলোর সৃষ্টি তার কাছে এক অতিমানবীয় শক্তির প্রকাশ। কিন্তু তার মধ্যে কোন সংগ্রামী চরিত্র খুঁজে পাননি রোলাঁ। তিনি শুধুই একজন মহৎ শিল্পী। তাই তাঁর বিঠোফেনের তুলনায় মিকেলেঞ্জলোর উত্তৰ্ষতা অনেক কম।