স্যার আউসলী এর মতে ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের ফারেস প্রদেশের অন্তর্গত সিরাজ নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আয়ু ১২০ বছর। তবে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু সাল নিয়ে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে তাঁর জন্ম সাল ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দ এবং আয়ু ১০২ বছর। কিন্তু মুজাফফর উদ্দীন আতাবেক সা’দ বিন জঙ্গীর রাজত্বকালে যে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন তাতে কোন দ্বিমত নেই। বাল্যকালে তাঁর নাম ছিল শেখ মোসলেহ উদ্দীন। জানা যায়, ফারেসের শাসনকর্তা আতাবেক সা’দ বিন জঙ্গীর রাজত্বকালে তিনি যখন কবিতা লিখতেন তখন আপন নামের সাথে ‘সা’দী’ লিখতেন এবং এ নামেই তিনি সুখ্যাতি লাভ করেন। সা’দীর পিতা রাজ দরবারে চাকুরী করতেন এবং তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক। ফলে শৈশব থেকেই সা’দীর পিতা রাজ দরবারে চাকুরী করতেন এবং তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক। ফলে শৈশব থেকেই সা’দী ধর্মীয় অনুশাসনের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেন। কোন অসৎ সঙ্গ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। শৈশবেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় অসাধারণ প্রতিভা। শিক্ষা লাভের প্রতি ছিল তাঁর অস্বাভাবিক আগ্রহ। কিন্তু শৈশবেই পিতা মৃত্যু বরণ করায় তিনি হয়ে পড়েন নিতান্ত ইয়াতীম ও অসহায়। পিতার আর্থিক অবস্থাও ভাল ছিল না। সরকারী চাকুরী করে পিতা যে সামান্য বেতন পেতেন তা দিয়েই খুব কষ্ট করে তাঁকে সংসার চালাতে হত। কিন্তু পিতার মৃত্যুতে সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্রতা এবং তাঁর শিক্ষা লাভের উপর আসে মারাত্মক আঘাত। কিন্তু এ অসহায়ত্ব ও দারিদ্রের মধ্যেও তিনি ধৈর্য্য হারাননি। শেখ সা’দী (রঃ) এর জীবনকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ৩০ বছর শিক্ষা লাভ, দ্বিতীয় ৩০ বছর দেশ ভ্রমণ, তৃতীয় ৩০ বছর গ্রন্থ রচনা এবং চতুর্থ ৩০ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তা ও সাধনা।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিরাজ নগরের গজদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কারো মতে ফারাসের শাসনকর্তা আতাবেক সা’দ বিন জঙ্গী দয়াপর্বশ হয়ে স্বয়ং ইয়াতীম শেখ সা’দীর আশ্রয় দান বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। উক্ত মাদ্রাসায় নিশ্চিত মনে বেশী দিন শিক্ষা লাভ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ তখন রাজ্যের সর্বত্র রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি বিরাজ করছিল। তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় দারিদ্রের সাথে লড়াই করে চলে যান বাগদাদে। বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসা ছিল তঙ্কালীন বিশ্বের সবৃশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাগদাদে এসে তিনি অনাহারে, অর্ধাহারে এবং আশ্রয়ের অভাবে দিনের পর দিন পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। অতঃপর তিনি একজন সহৃদয় ব্যক্তির সহযোগিতায় স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে শিক্ষা লাভ শুরু করেন। তাঁর প্রতিভা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং শিক্ষা লাভে তার অসাধারণ পরিশ্রমের প্রেক্ষিত খুব অল্প সময়ের। মধ্যেই তাঁর প্রতি শিক্ষকগণের সুদৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এরপর তিনি ভর্তি হন বাগদাদের নিযামিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি বিখ্যাত আলেম আল্লামা আবুল ফাতাহ ইবনে জওজী (রঃ) এর নিকট তাফসীর, হাদিম ও ফিকাহ শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি মাদ্রাসার প্রধান ছাত্র হিসেবে পরিগণিত হন এবং মাসিক বৃত্তি লাভ করেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি তাফসীর, হাদিস, ফিকাহ, সাহিত্য, দর্শন, খোদাত ও ইসলামের বিবিধ বিষয়ে অসামান্য পান্ডিত্য অর্জন করেন। আল্লামা শেখ সাদী (রঃ) শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভেই সন্তুষ্ট ছিলেন না; বরং আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের প্রতিও ছিল তাঁর অস্বাভাবিক আগ্রহ। শেখ সাদী (রঃ) এর জন্মের ১০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১১৬৫ খ্রি: (৫৬১ হিঃ) তোপসশ্রেষ্ঠ শেখ আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁর অলৌকিক তপঃ প্রভাবের কথা সমগ্র বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। শেখ সাদী (রঃ) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের অবসর সময়ে ধন্য পুরুষদের আশ্রমে গিয়ে অতীন্দ্রিয় জগতের তথ্য সংগ্রহ করতেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি তকালীন তপস শেখ শাহাবুদ্দিন (রঃ) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ধন্য পুরুষদের সঙ্গ লাভে অল্প দিনের মধ্যেই তার ধর্মগত প্রাণ তত্ত্বজ্ঞান ও পুণ্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
৩০ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর শুরু হয় তাঁর ভ্রমণ জীবন। জ্ঞান পিপাসা চরিতার্থ করার মানসে সংসার বৈরাগীর ন্যায় খালি হাতে তিনি পদব্রজে বিচরণ করেছেন জগতের বিভিন্ন দেশ এবং নানা স্থানে উপদেশ বিতরণের মাধ্যমে লোকদের ধর্ম ও সভ্যতার পথে উন্নীত করেছেন। স্যার আউসলী’র মতে প্রাচ্য জগতে সুবিখ্যাত ইবনে বতুতার পরে পরিব্রাজক হিসেবে যার নাম শীর্ষে রয়েছে, তিনি হলেন মাওলানা শেখ সা’দী (রঃ)। ডদব্রজ বা উষ্ট্রপৃষ্ঠ ব্যতীত যখন মরুভূমি পার হবার কোন উপায় ছিল না তখন শেখ সাদী (রঃ) শ্বাপদসঙ্কুল ও অসভ্য বর্বর অধুষিত জনপদের শত সহস্র বিপদ উপেক্ষা করে পব্রজে ভ্রমণ করেছিলেন দেশ থেকে দেশান্তরে। তিনি সমগ্র পারস্য, এশিয়া মাইনর, আরবভূমি, সিরিয়া, মিসর, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান, ফিলিপাইন, ইরাক, কাশগড়, হাবস, ইয়ামন, শাম, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, হিন্দুস্তানের সোমনাথ ও দিল্লীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। পব্রজে ভ্রমণ করেছিলেন। এ সময় দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে তাঁকে পার হতে হয়েছিল পারস্য উপসাগর, ওমান সাগর, ভারত মহাসাগর, আরব সাগর প্রভৃতি। এ সুদীর্ঘ সফরের ফলে তিনি বিশ্বের ১৮টি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। পদব্রজে তিনি হজ্জ সম্পাদন করেছিলেন ১৪ বার। তাঁর এ ভ্রমণ কাহিনী তিনি তার গুলিস্তা ও বোস্তা বিতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। গুলিস্তায় তিনি লিখেছেন–