এ মনীষী পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক কিতাব রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে আল কানুন, আশ শেফা, আরযু ফিত তিব্ব, লিসানুল আরব, আল মজনু, আল মুবাদাউন মায়াদা, আল মুখতাসারুল আওসাত, আল্ আরসাদুল কলিয়া উল্লেখযোগ্য। আল কানুন কিতাবটি তকালীন যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। কারণ এত বিশাল গ্রন্থ সে যুগে অন্য কেউ রচনা করতে পারেনি। আল কানুন কিতাবটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয় এবং তৎকালীন ইউরোপের চিকিৎসা বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আল্ কানুন ৫টি বিশাল খণ্ডে বিভক্ত যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ লক্ষাধিক। কিতাবটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। প্রকৃত পক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের তিনিই হলেন জনক। আশ শেফা’ দর্শন শাস্ত্রের আর একটি অমূল্য গ্রন্থ, যা ২০ খণ্ডে বিভক্ত ছিল। এতে ইবনে সিনা রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব ও উদ্ভিদ তত্ত্বসহ যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি মানুষের কল্যাণ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে আজীবন পরিশ্রম করেছেন এবং ভ্রমণ করেছেন জ্ঞানের সন্ধানে। তিনিই সর্বপ্রথম মেনেনজাইটিস রোগটি সনাক্ত করেন। পানি ও ভূমির মাধ্যমে যে সকল রোগ ছড়ায় তা তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। সময় ও গতির সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তিনিই আবিষ্কার করেন। তিনি এ্যারিস্টটলের দর্শন ও ভালভাবে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু এ্যারিস্টটলের কিছু কিছু মতবাদের সাথে তিনি একমত হলেও সকল মতবাদের সাথে তিনি একমত হতে পারেননি।
জীবন সায়াহ্নে ফিরে আসেন তিনি হামাদানে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন তিনি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। একদিন তার এক ভূত ঔষধের সাথে আফিম মিশিয়ে দেয়। আফিমের বিষক্রিয়ায় তার জীবনী শক্তি শেষ হয়ে আসে। ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে মহাজ্ঞানী ও বিশ্ববিখ্যাত এ মনীষী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হামাদানে তাকে সমাহিত করা হয়।
“আল্লাহর ভয় মানুষকে সকল ভয় থেকে মুক্তি দেয়।”…ইবনে সিনা।
১২. ওমর খৈয়াম (১০৪৪-১১২৩ খ্রি:)
ওমর খৈয়াম ১০৪৪ খিস্টাব্দে খোরাসানের রাজধানী নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম গিয়াস উদ্দীন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম। কিন্তু তিনি ওমর খৈয়াম নামেই সমগ্র বিশ্বে পরিচিত। খৈয়াম হচ্ছে বংশগত উপাধি। খৈয়াম শব্দের অর্থ হচ্ছে তাবু নির্মাতা বা তাবু ব্যবসায়ী। সম্ভবত বংশের কেউ তাবু তৈরি করতেন কিংবা তাবুর ব্যবসা করতেন। আর সে থেকেই বংশের কিংবা পারিবারিক উপাধি হয়েছে খৈয়াম। আসলে তিনিই ছিলেন খৈয়াম অর্থাৎ তাবু নির্মাতা। তিনি জ্ঞানের যে তাবু নির্মাণ করে গেছেন, আজও বিশ্বের অগণিত জ্ঞান পিপাসু মানুষ প্রবেশ করে জ্ঞানের সে তাবুর অভ্যন্তরে এবং আহরণ করে জ্ঞান। ওমর খৈয়ামের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। এমন কি এ মনীষীর জন্ম তারিখ নিয়েও রয়েছে মতভেদ। পারস্য ঐতিহাসিকগণের মতে গজনীর সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আনুমানিক ১০১৮ থেকে ১০৪৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশ্ব বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অংক শাস্ত্রবিদ, অর্জন করার তেমন কোন আশা আকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। তিনি কেবল মাত্র আত্মসন্তুষ্টির জন্যে বিজ্ঞান চর্চার অবসর সময়ে মনের খেয়ালে এক ধরনের চতুস্পদী কবিতা লিখতেন। তিনি নিজ মাতৃভূমি ইরানেও জীবিতাবস্থায় কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। অথচ মনের খেয়ালে তার লিখিত কবিতাগুলো আজ সমগ্র বিশ্বে হয়েছে সমাদ্রিত এবং দখল করেছে সাহিত্য ও কবিতা জগতের শ্রেষ্ঠ সিংহাসন। ওমর খৈয়াম আজ সমগ্র বিশ্বের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইউরোপীয়রা অত্যন্ত কৌশলে এ মহামনীষীকে বিশ্ব বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর পরিবর্তে কেবলমাত্র একজন কবি হিসেবে পৃথিবীর মানুষের সামনে পরিচিত কারার চেষ্টা করেছেন। ওমর খৈয়ামের মৃত্যু প্রায় ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডোয়ার্ড ফিজারেল্ড খৈয়ামের ‘রুবাইয়াত’ নামক চতুষ্পদ কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদের দ্বারা সমগ্র ইউরোপে তাঁর রুয়াইয়াত ছড়িয়ে দেয় এবং তিনি কবি হিসেবে পরিচয় লাভ করেন।
ওমর খৈয়াম ছোট বেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। তাঁর স্মরণ শক্তি এত প্রখর ছিল যে, যে কোন দর্শন গ্রন্থ এবং কঠিন কঠিন কিতাব সমূহ মাত্র ৬/৭ বার পাঠ করেই তা মুখস্থ করে ফেলতেন। তাঁর মেধা ও প্রতিভার সামনে সক্রেটিস, এ্যারিস্টটল এবং ইউক্লিড এর প্রতিভাও ম্রিয়মান হয়ে যায়। ওমর খৈয়ামের শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম মোয়াফিক। মনীষী ওমর খৈয়ামের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। আমীর আবু তাহির তাকে জ্ঞান চর্চার জন্যে কিছু অর্থ সাহায্য করেন এবং রাজ্যের সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে তাঁর আর্থিক দূরাবস্থা সামান্য লাঘব হয়। রাষ্ট্রীয় সাহায্য পেয়ে ওমর খৈয়াম ভোগ বিলাসকে স্পর্শও করেননি। বরং রাষ্ট্রীয় সাহায্য তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান সাধনা ও গবেষণার কাজে সহায়তা করেছিল। কোন বই হাতে পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করে ফেলতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, বীজ গণিত ও জ্যামিতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। এছাড়া দর্শন শাস্ত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। মানুষ হিসেবে ছিলেন তিনি খাঁটি মুসলমান ও আল্লাহ প্রেমিক।