এখানে কোরআন সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করছে যে, নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত করার ব্যাপারটা যোনিতে নিক্ষেপিত পুরুষ-বীর্যের পরিমাণের উপরে আদৌ নির্ভরশীল নয়, আধুনিক টেস্ট টিউবে সন্তান উৎপাদনেও বিষয়টা প্রমাণিত। কোরআনের এই বক্তব্য আমাদের আলোচ্য পর্যালোচনার জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, প্রজননের ক্ষেত্রে কোটি কোটি শুক্রকীটধারী পুরুষ-বীর্যের এই অণু-ভগ্নাংশ অর্থাৎ শুধু শুক্রকীট বা একক জীবকোষ এবং তার ভূমিকা মোটেও খালি চোখে দেখার ব্যাপার নয়। অতীতে পুরুষের বীর্যের এই জীবন্ত জীবকোষ বা শুক্রকীট ও তার ভূমিকা-সম্পর্কে মানুষ আদৌ অবহিত ছিল না। ফলে, এই আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যায় অনেকে বিষয়টা শুধু যে গুলিয়ে ফেলেছেন, তাই নয়, এ সম্পর্কে তাঁরা যে ধারণা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন, তাও ছিল বিভ্রান্তিকর।
এ কথা সবার জানা যে, পুরুষ-বীর্যে শুক্রকীটের অস্তিত্ব আবিস্কৃত এবং তার ভূমিকা সনাক্ত করা হয়েছে–এই কিছুদিন আগে, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। অথচ, তখনও হাজার বছর আগে সপ্তম শতাব্দীর কোরআন এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য ঘোষণা করেছে এবং একান্ত আধুনিক যুগে এসে শুধু বিজ্ঞানের গবেষণায় তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। মূলত, শুক্রকীট এতই সূক্ষ্ম যে, খালি চোখে তা দেখার আশা করা বাতুলতা মাত্র। শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে শুক্রকীটের যে আকার-আয়তন পাওয়া গেছে, তা এক মিলিলিটারের সহস্র ভাগের এক ভাগ মাত্র। এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অতিসূক্ষ্ম শুক্রকীটই হচ্ছে, বীর্যের মূল উপাদান বা সারভাগ।
এই অণুবিন্দু পরিমাণ শুক্রকীটের সঙ্গে থাকে ডি. এন. এ. টেপ (আধুনিক বিজ্ঞান আবিস্কৃত এক ধরনের এসিড যার ভূমিকা হল কোনকিছু পরিবহন করা)। এই ডি. এন. এ. টেপের দ্বারাই পিতার ‘জিন’ ভ্রূণ তথা সন্তানের মধ্যে চালিত হয়। এবং এভাবে পিতৃ-জিন এবং (ডিম্বাণুর মাধ্যমে পরিবাহিত) মাতৃ জিন সম্মিলিতভাবে গঠন করে শিশুর ভবিষ্যৎ। একেই সাধারণ ভাষায় বলা হয়ঃ ‘বংশগত উত্তরাধিকার’।
পুরুষের প্রজনন-সেলের (শুক্রকীট) মধ্যস্থিত জিন এবং নারীর প্রজনন কোষের (ডিম্বাণু) মধ্যস্থিত জিন যৌথভাবে নির্ধারণ করে গর্ভস্থ শিশুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমরা জেনেছি, প্রজননের কাজ শুরু হওয়ামাত্রই জিন-বহনকারী শুক্রকীটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়ে যায় গর্ভস্থ সন্তান ছেলে হবে, না মেয়ে হবে।
শুক্রকীট যদি হেমিক্রোমোজম ‘ওয়াই’ হয়, তবে সন্তান হবে পুত্র; আর তা যদি ‘এক্স’ হয়, তবে হবে কন্যা। এ পর্যায়ে কারো পক্ষেই নির্ধারণ করার উপায় যে, গর্ভস্থ সন্তান পুত্র হবে না কন্যা হবে। কেননা, বীর্যের সঙ্গে কোটি কোটি শুক্রকীট নিক্ষিপ্ত হয় যোনিগর্ভে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে শুধু শুক্রকীট নারীর ডিম্বাণুতে অনুপ্রবেশে সক্ষম হয়, বাকিগুলো বরণ করে ব্যর্থতা বা মৃত্যু। ডিম্বাণুতে অনুপ্রবেশকারী শুক্রকীটটি যদি ‘এক্স’ হেমিক্রোমোজম হয়, তাহলে শিশুটি হবে কন্যা, আর তা যদি ‘ওয়াই’ হয় তাহলে সেই সন্তান হবে পুত্র। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, জন্মসূত্রে ঠিক সেই মুহূর্তেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয়ে যায়, যে মুহূর্তে পুরুষের বীর্যস্থ কোটি কোটি শুক্রকীটের মধ্যথেকে একটিমাত্র শুক্রকীট নারীর ডিম্বাণুতে অনুপ্রবেশ ঘটে।
তাছাড়া, যোনিগর্ভে নিক্ষেপিত পুরুষ-বীর্যের পরিমাণের তুলনায় সেই শুক্রকীটটি যে অণুবিন্দু ভগ্নাংশের চেয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সূক্ষ্ম, সে কথা তো আগেই বলা হয়েছে। অবশ্য, ভ্রূণ-সৃষ্টির পর নির্ধারিত একসময় আন্দ্রা সোনোগ্রাফিক স্ক্যানিং-এর মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তান পুত্র না কন্যা? বিজ্ঞান তা এখন জানাতে সক্ষম। তবুও, শুক্রকীট কর্তৃক ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার আগেপর্যন্ত কারোপক্ষেই সন্তানের লিঙ্গ-পরিচয় জানা সম্ভব নয়। এই পটভূমিকায়ই কোরআন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে যে, গর্ভের সন্তান পুত্র হবে না কন্যা হবে, একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া তা আর কেউ জানে না। এদিকে এই অণুবিন্দু ভগ্নাংশের চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শুক্রকীটের সঙ্গে পরিবাহিত হয়ে থাকে সেই জিন–যা সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের পাশাপাশি নির্ধারণ করে দেয় সেই সন্তানের গড়ন, ভবিষ্যৎ চেহারা এবং তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও! এই কথাটাই কোরআনের নিমোক্ত আয়াতে অত্যন্ত পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছেঃ
“এক অণুবিন্দু পরিমাণ তরল পদার্থ হইতে (আল্লাহ) তাহাকে গঠন করেন (সুষম মাত্রায়), এবং নির্ধারণ করিয়া দেন তাহার নিয়তি।”।–সূরা ৮০ (আবাসা), আয়াত ১৯ :
“খালাকা” শব্দের সাধারণ প্রচলিত অর্থ ‘সৃষ্টি করা’। কিন্তু তার আদি-অর্থ ধরে নিয়েই এখানে ‘খালাকা’ শব্দের তরজমা করা হলো—’সুষম মাত্রায় গঠন করা’ কিংবা ‘নির্মাণ করা’ অথবা ‘সৌষ্ঠব দান করা’।
কোরআনের এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, পিতৃবীর্যের মধ্যস্থিত শুক্রকীটের দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার মুহূর্তেই শিশুর নিয়তি বা ভাগ্য নির্ধারিত হয়। বিজ্ঞানও জানাচ্ছে, পিতৃবীর্যের মধ্যস্থিত শুক্রকীট নির্ধারণ করে সন্তানের লিঙ্গ এবং ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার মুহূর্ত থেকে পিতৃ ও মাতৃ জিন-এর ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় পরিগঠিত হতে শুরু করে সন্তানের চেহারা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি। এভাবেই সন্তান লাভ করে তার বংশগত উত্তরাধিকার। আর একইভাবে জিন-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত জীবাণীশক্তি, আয়ুষ্কাল, স্বাস্থ্য, ভালমন্দ, গুণাগুণ সবমিলিয়ে নির্ধারিত হয় সন্তানের নিয়তি অর্থাৎ তার ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ। সুতরাং, স্বীকার করতেই হবে, আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কার বিশেষত জিন–সম্পর্কিত প্রাপ্ত-তথ্য আর কোরআনের বাণীতে উপস্থাপিত বক্তব্যের মিল-মিছিল শুধু বিস্ময়কর নয়, অনুসন্ধিৎসু সকলের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণীয়ও বটে।
৩৮. প্রসঙ্গ : সংমিশ্রিত বীর্য
পুরুষের বীর্য যে বিভিন্ন গ্ল্যান্ড-নিঃসৃত উপাদানে গঠিত একটি সংমিশ্রিত তরল পদার্থ, তা আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। কথাটা কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এভাবে: