এই যে পুরুষের বীর্য, যা থেকে নারীর গর্ভাধারণ হয়ে থাকে, সেই বীর্য তৈরি হয় পুরুষের অণ্ডকোষে। সেখানে এই বীর্য তৈরির ব্যবস্থা যেমন রয়েছে; তেমনি সেখানে সেই বীর্য মওজুদ রাখার জন্যও রয়েছে বিশেষ-ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে সেই বীর্য সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যও রয়েছে। নির্দিষ্ট নালিপথ। যৌনমিলনের পরিণতিতে পুরুষের বীর্য এই নালিপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে তার মওজুদ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার পথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্ল্যান্ডের বহুবিধ তরল পদার্থের সঙ্গে তা সংমিশ্রিত হয়।
অবশ্য, এসব গ্ল্যান্ড-নিঃসৃত তরল পদার্থের কোনটাতেই নারীর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার বা উর্বরতা প্রদান করার মত কোনও উপাদান থাকে না। নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় শুধু পুরুষের অণ্ডকোষ-নিঃসৃত শুক্রকীটের দ্বারাই। তবে অপরাপর গ্ল্যান্ড-নিঃসৃত পদার্থসমূহ সংশ্লিষ্ট শুক্রকীটটিকে এমনভাবে নারীর ডিম্বাণুর নাগালে পৌঁছাতে সহায়তা করে যার ফলে ডিম্বাণুটি সহজেই নিষিক্ত হয়, হয় উর্বরতাপ্রাপ্ত। প্রকৃতপক্ষে, পুরুষের বীর্য হচ্ছে এমন একটি তরল পদার্থ যাতে রয়েছে শুক্রকীট ছাড়াও অন্যবিধ তরল পদার্থের সংমিশ্রণ। এভাবে পুরুষবীর্যের সহায়তায় উর্বরতাপ্রাপ্তির পর নারীর ডিম্বাণুটি ফেলোপিয়ন টিউবের মাধ্যমে জরায়ুগর্ভে নীত হয়। এই নীত হওয়ার সময় থেকেই শুরু হয় উর্বরতাপ্রাপ্ত ডিম্বাণুতে প্রবেশকারী শুক্রকীট তথা একক জীবকোষের বিভক্তির কর্মধারা। এরপর উর্বরতাপ্রাপ্ত ডিম্বাণুবাহী ওই শুক্রকীটটি আক্ষরিক অর্থেই ‘রোপিত’ হয় জরায়ুগর্ভের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি ও পেশীর মধ্যে। পরবর্তী পর্যায়ে এদেরই সমবায়ে গঠিত হয় গর্ভফুল।
এভাবে নারীর গর্ভাধানের পর ভ্রণটি যখন খালি চোখে দেখার মত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তার অবস্থা দাঁড়ায় অতিক্ষুদ্র একখণ্ড মাংসপিণ্ড ৪ আলাদা করে বুঝবার মত আর কোন অঙ্গের অস্তিত্ব তখন সেখানে থাকে না। এই অবস্থায় সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাংসপিণ্ডটি ক্রমান্বয়ে সেখানে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। এরপর বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সেই আকার-অবয়বহীন মাংসপিণ্ডটি একসময় ধারণ করে মানবাকৃতি।
অবশ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্রূণের কোন কোন অঙ্গ বিশেষত মাথাটি বাকি দেহের তুলনায় বৃহদায়তন হয়ে থাকে। পরে অবশ্য মাথার আয়তন হ্রাস পায় এবং একসময় সেই ভ্রূণটি প্রাণবাহী দেহ-কাঠামোর রূপ পরিগ্রহ করে। এভাবে ক্রমান্বয়ে সেই প্রাণবাহী ভ্রূণটি একে একে লাভ করে মাথার খুলি, মাংসপেশী, রক্তসংবাহী শিরা-উপশিরা, নাড়ীভূঁড়ি ইত্যাদি।
মোটামুটিভাবে, এই হচ্ছে মানব-প্রজনন-সংক্রান্ত আধুনিক বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণাজাত তথ্য যা একাধারে সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত; এবং মানব-প্রজননের এই ধারা অপরিবর্তনীয়ভাবেই অব্যাহত রয়েছে।
মানব-প্রজনন সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্য উপাত্ত উপরে তুলে ধরা হয়েছে। এবারে আমরা ওইসব তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে কোরআনে বর্ণিত মানব-প্রজনন-সংক্রান্ত বাণী ও বক্তব্যের তুলনামূলক বিচার পর্যালোচনা শুরু করা যায়।
কোরআনে মানব-প্রজনন সম্পর্কে যেসব বাণী (আয়াত) রয়েছে, আলোচনার সুবিধার্থে সেগুলোর মূলবক্তব্য প্রথমেই সংক্ষেপে তুলে ধরা হচ্ছে। যথা :
(১) নারীর ডিম্বাণুকে উর্বরতা প্রদানের জন্য প্রয়োজন পুরুষ-বীর্যের এক ক্ষুদ্র অণু-ভগ্নাংশ;
(২) পুরুষের বীর্য বিভিন্ন উপাদানে পরিগঠিত এক সংমিশ্রিত তরল পদার্থ
(৩) উর্বরতাপ্রাপ্ত ডিম্বাণুর রোপণ-প্রক্রিয়ার কাজটি ঘটে জরায়ুতে; এবং
(৪) জরায়ুগর্ভে ভ্রূণের নানা বিবর্তনক্রিয়া সাধিত হয়।
.
সামান্যতম বীর্য : শুক্রকীট
“(আল্লাহ) গঠন করিয়াছেন মানুষকে সামান্যতম পরিমাণ (শুক্র) হইতে।”–সূরা ১৬ (নহল), আয়াত ৪ :
এই একই বক্তব্য কোরআনে উচ্চারিত হয়েছে মোট এগারোবার। এসব আয়াতে যে আরবী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেই ‘নুৎফা’ শব্দের অনুবাদ এখানে করা হয়েছে ‘সামান্যতম পরিমাণ শুক্র’। মূলত, এই আরবী শব্দটি দ্বারা যা বুঝানো হয়েছে, তার সঠিক অর্থ ও ভাবপ্রকাশকারী কোনও শব্দ আমাদের জানা নেই। কোন কোন অনুবাদক এই ‘নুৎফা’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘একবিন্দু’। আরবী যে ক্রিয়াপদ থেকে এই শব্দটি (নুৎফা) এসেছে তার মর্মার্থ হল : ফোঁটা ফোঁটা করে চুয়ানো (টু ড্রিবল, টু ট্রিকল)। কোন পাত্র থেকে তরল কিছু ঢেলে ফেলে দেয়ার শেষপর্যায়ে সেই পাত্র থেকে সেই তরল পদার্থের যেমন কিছু চুঁইয়ে পড়ে, তেমনি। অন্যকথায়, ‘নুৎফা’ হল ‘অতি সামান্যতম পরিমাণ তরল পদার্থ’। এই শব্দের দ্বিতীয় অর্থ ‘এক ফোঁটা পানি’। এইক্ষেত্রে এই শব্দটির দ্বারা বুঝানো হয়েছে, বীর্যের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-ভগ্নাংশ’। কেননা, কোরআনের অপর এক আয়াতে এই ‘নুৎফা’ শব্দটিকে ‘বীর্য’ (আরবী ‘মনি’ : চলতি বাংলায়ও ‘মনি’ শব্দটি ‘বীর্য’ অর্থেই চালু রয়েছে) শব্দের সঙ্গে যুক্তভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যথা :
“সে (মানুষ) কি সেই অতি সামান্যতম শুক্র ছিল না–যাহা সজোরে নির্গত/নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল?”–সূরা ৭৫ (কিয়ামাহ্), আয়াত ৩৭ :