এই ‘জিন’-এর আবিষ্কার মানব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধন করেছে এক বিপ্লব। বংশগতির ধারায় ‘জিন’-এর ভূমিকা এতই অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর যে, তা ইতিপূর্বের এতদসংক্রান্ত বহুতত্ত্ব ও ধারণাকে পাল্টে দিয়েছে। যাহোক, সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই ‘জিন’-এর দ্বারা সংশোধিত ও পরিমার্জিত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে বিকৃত হয়ে ভ্রূণের বেলায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর বেলায় যে পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটে, তা সেই সন্তানটিকে দান করে দৈহিক কাঠামোগত এমন এক বৈশিষ্ট্য–যা এককথায় একক এবং অনন্য।
শুধু একটি ডিম্বকোষ ঘটনাচক্রে যদি (এবং তা অবশ্যই ব্যতিক্রম) দুটি পৃথক শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত হয় এবং তার ফলে যে জমজ সন্তানের জন্ম হয়, সেই বিশেষ শ্রেণীর জমজ ছাড়া কোন-একজন মানুষই কোন দিক দিয়েই অপর কোন মানুষের মত হয় না। না চেহারা সুরতে, না আচার-আচরণে। একেবারে প্রাথমিক স্তরে জিন-এর এই ভূমিকা মানুষের দেহাবয়বগত পার্থক্য প্রদানের। ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তার ভূমিকা দাঁড়ায় ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর।
এভাবেই বংশপরম্পরায় মানবজাতির মধ্যে সার্বিক ও সামগ্রিকভাবে পরিবর্তনের যে ধারা চলে এসেছে, সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই পরিবর্তনই’ ক্রমান্বয়ে একটি একটি করে গোটা মানব-প্রজন্মকে বদলে দিয়েছে সম্পূর্ণভাবেই। আধুনিক জীবাশ্ম-বিজ্ঞান এখন অতীতের মানব-প্রজন্মের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্বের যে প্রতিষ্ঠিত তথ্য-প্রমাণ পেশ করছে, তা মূলতঃ পুরুষানুক্রমে বিভিন্ন মানব-প্রজাতির মধ্যে জিন-এর এই ভূমিকাজাত রূপান্তরেরই ইতিবৃত্ত।
এই পর্যায়ে কোরআনে মানব-প্রজনন সম্পর্কে যে বক্তব্য রয়েছে তার বিচার-বিশ্লেষণ অনিবার্য হয়ে দেখা দেবে স্বাভাবিকভাবেই। সুতরাং, বিষয়টি কোরআনের মত একটি ধর্মগ্রন্থের বাণী ও বক্তব্যের তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কয়েকটি কথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। যেমন:
কোরআন নাজিল হয়েছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে।
তখন রচিত যেকোন পুস্তকের মানব-প্রজনন-সম্পর্কিত যেকোন তথ্যই আধুনিক বিজ্ঞানের নিরিখে ভ্রান্তিপূর্ণ হতে বাধ্য।
কেননা, বিজ্ঞান তখন মোটেও তেমন কোন উন্নতি বা উৎকর্ষতা লাভ করেনি।
তখন বিশ্বের সর্বত্র মানব-প্রজনন সম্পর্কে মানুষের চিন্তা-ভাবনা এমনকি জ্ঞান-প্রজ্ঞাও যতসব উপকথা ও কুসংস্কারজাত ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত। যা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
এখন আমরা দেহবিজ্ঞান, জণতত্ত্ব ও ধাত্রীবিদ্যা সম্পর্কে যে অত্যাধুনিক তথ্য-জ্ঞান অর্জন করেছি, তা মূলত মানবদেহ-সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণার অবদান।
এমতাবস্থায় সপ্তম শতাব্দীর কোন পুস্তকে মানবদেহযন্ত্রের মত জটিল একটি বিষয়ে কতটুকু জ্ঞান আমরা আশা করতে পারি? এবং তা থেকে মানব-প্রজননের মত জটিলতর বিষয়ের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানার ও বুঝার মত কতটুকু তথ্য আমরা পেতে পারি?
৩৭. বিজ্ঞানের আলোকে : মানব-প্রজনন
এই আলোচনা অবতারণার উদ্দেশ্য এই যে, এর দ্বারা আমরা নতুন কোন থিওরি বা তত্ত্ব জানাতে চাই। বরং, এই আলোচনার দ্বারা একটি সত্যই তুলে ধরতে চাই, সপ্তম শতাব্দীতে অবতীর্ণ কোরআনে মানব-প্রজনন সম্পর্কে এমন সব তথ্য ও ধারণা প্রদান করা হয়েছে যা সর্বাধুনিক বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরেও বাস্তব এবং সঠিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। এ কথা সবারই জানা কোন থিওরি বা তত্ত্ব সাধারণ নিয়মানুসারেই পরিবর্তনশীল। সে কারণে শুধু তত্ত্বগত জ্ঞান সম্বল করে ও শুধু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে হাত দেয়ার অর্থ অসংখ্য তত্ত্বের জালে জড়িয়ে পড়ে দিশাহারা হওয়া। তাছাড়া, এখন যে তত্ত্ব সঠিক বলে বিজ্ঞানে পরিগৃহীত হচ্ছে, কাল সেই তত্ত্ব ভিত্তিহীন বা অকেজো বলে প্রমাণিত ও পরিত্যক্ত হওয়া বিচিত্র কিছু নয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে।
মূলত, বিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কোনকিছুর তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পড়ে এমনসব তথ্য ও উপাত্তের যা অপরিবর্তনীয়। শুধু তাই নয়, সেইসব তথ্য এমন হওয়া আবশ্যক যেন প্রয়োজনে বাস্তবেও সেগুলোর কার্যকর প্রমাণ দাখিল করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠিত তথ্য-প্রমাণের আলোকে কোনকিছু তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম পদ্ধতি।
যাহোক, মানুষের জন্ম তথা মানব-প্রজননের কাজটা বিশেষ কতকগুলো দৈহিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মাধ্যমে চালু রয়েছে। সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও গবেষণায় এসব প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি শনাক্ত ও বিশ্লেষিত করাও সম্ভব হয়েছে। এভাবেই বিজ্ঞান এখন জানিয়ে দিচ্ছে যে, মানব-প্রজননের সূচনা ঘটে নারীর ফেলোফিয়ন টিউবে (ডিম্বাশয় থেকে বহির্গত নালী)–ডিম্বাণুর উর্বরতাপ্রাপ্তির মাধ্যমে।
এই ডিম্বাণুটি দুই ঋতুস্রাবের মধ্যবর্তী সময়ে নারীর ডিম্বকোষ থেকে স্খলিত হয়। এই ডিম্বাণুটিকে উর্বরতা প্রদান করে থাকে পুরুষের শুক্রকীট–যা মূলত একটি জীবকোষ। যৌনমিলনের কালে পুরুষ কর্তৃক নিঃসৃত এক কিউবিক সেন্টিমিটার পরিমাণ বীর্যে এরকম কোটি কোটি শুক্রকীট অবস্থান করে। কিন্তু নারীর ডিম্বাণুকে উর্বরতা প্রদান করে একটিমাত্র শুক্রকীট। অর্থাৎ, পুরুষ-নিঃসৃত বীর্যের মধ্যস্থিত শুধু একটি একক জীবকোষই নারীকে গর্ভবতী করে থাকে। অন্যকথায়, যৌনমিলনের কালে স্খলিত বীর্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অণু-ভগ্নাংশই নারীর ডিম্বাণুকে উর্বরতা প্রদানের জন্য তথা নারীকে গর্ভবতী করার জন্য যথেষ্ট।