কোন-এক মানবজাতির স্থলে অন্য এক মানবজাতির আবির্ভাবের বক্তব্য কোরআনের নিমোক্ত দুটি আয়াতে বিদ্যমান। যথাঃ
“নিশ্চয় আমরা তাহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং তাহাদের সবাইকে করিয়াছি শক্তিসম্পন্ন (বা তাহাদের গঠনকে মজবুত করিয়াছি); এবং যখন আমরা ইচ্ছা করিয়াছি, তাহাদিগকে সম্পূর্ণভাবে সরাইয়া দিয়া (অথবা বদলাইয়া দিয়া) তদস্থলে অনুরূপ ধরনের মানুষকে করিয়াছি স্থলাভিষিক্ত।” –সূরা ৭৬ (দাহর), আয়াত ২৮ (সূত্র নং ১৮) :
উপরের আয়াতে মানুষের শারীরিক গঠন-কাঠামোর যে কথা বলা হয়েছিল, এখানে তাকে ক্ষমতাসম্পন্ন করার বা তার গঠন মজবুত করার কথা বলে খুব সম্ভব সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষের সেই দেহাবয়বগত ক্ৰম-উন্নয়নের তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে।
“তিনি (আল্লাহ) চাহিলে তোমাদিগকে বিলুপ্ত করিতে পারেন, এবং তিনি যাহাদিগকে চাহিবেন, উত্তরাধিকারী হিসেবে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করিতে পারেন–ঠিক যেভাবে অন্য মানুষের বংশধর হইতে তোমাদের উদ্ভব ঘটাইয়াছেন।” –সূরা ৬ (আনআম), আয়াত ১৩৩ (সূত্র নং ১৯) :
এই দুই আয়াতে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে সময়ের ধারাবাহিকতায় নির্দিষ্ট মানব-সম্প্রদায়ের অবলুপ্তি এবং তদস্থলে অন্যদের স্থলাভিষিক্তকরণের যে প্রক্রিয়া চালু ছিল–সেই বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
প্রাচীন তফসীরকারগণ এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় পাপাসক্ত মানব সম্প্রদায়ের উপরে আল্লাহর গজব ও আজাব নিপতিত হওয়ার ব্যাপারটাকে বড় করে তুলে ধরেছেন। এসব আয়াতের মর্মে ধর্মীয় এই তাৎপর্য প্রথমদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বটে; কিন্তু বাস্তবে সুগভীর বিচার-বিশ্লেষণে এটাও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যে, এই দুই আয়াতের অতীতের বহু মানব-সমপ্রদায়ের (যাদের সংখ্যা এখানে উল্লেখ করা হয়নি) বিলুপ্তির কথাই বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সময় বিশেষে অন্য মানুষের বংশধরদের দ্বারা এমনকি ভিন্ন কোন মানব-সম্প্রদায়ের দ্বারাও তাদের স্থান পূরণের কথাও এখানে উল্লিখিত হয়েছে সমান গুরুত্বের সাথেই।
সুতরাং, মোদ্দাকথাটা এখানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, বহুকাল আগে থেকেই বিভিন্ন সময় দুনিয়াতে যে সব মানবগোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল, তাদের মধ্যে ছিল শারীরিক গঠন-কাঠামোগত ভিন্নতা। তখনকার সেইসব মানুষের দেহাবয়বগত গঠন-কাঠামোর যে ভিন্নতা, সেই ভিন্নতা আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মে এক মহা সাংগঠনিক পরিকল্পনার অধীনেই ক্রমাগতভাবে রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত তথা সংশোধিত হয়ে চলেছে। এই সংশোধন তথা পরিবর্তন ও রূপান্তরের ধারায় একেক সময় একেক মানব সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি ঘটেছে; এবং সেই একইধারায় তাদের স্থান পূরণ করেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী।
উপরে যে-সব আয়াত তথা বাণী ও বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে–ওইসব বাণী ও বক্তব্যের দ্বারা কোরআন আলোচ্য এই বক্তব্যকে বিশদভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরছে। বলা অনাবশ্যক যে, জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের আবিষ্কার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণার সিদ্ধান্তও আশ্চর্যজনকভাবে একইরকম। এক্ষেত্রে প্রমাণিত হচ্ছে যে, জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে কোরআনের বাণী ও বক্তব্যের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। অন্যকথায়, মানুষের সৃষ্টি, তার গঠন সৌকর্য, মানবজাতির শারীরিক সংগঠন-কাঠামোর ক্রমবিকাশ, জাতিগতভাবে মানুষের দেহাবয়বের পরিবর্তন ও রূপান্তর ইত্যাদি সম্পর্কিত জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের আবিস্কৃত ও গবেষণালব্ধ তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে কোরআনের এতদসংক্রান্ত বাণী ও বক্তব্যের কোনও গরমিল নেই : গরমিল খুঁজতে গেলে বরং নিরাশই হতে হয়।
৩৬. প্রসঙ্গ কোরআন-এ প্রজনন : প্রজন্ম : রূপান্তর
মানুষের আদি উৎস কি? এ প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞান জানাচ্ছে যে, মানুষের এই রূপান্তরের কাজটি সম্পাদিত হয়েছে জেনেটিক কোড বা বংশগতির-ধারায় তথা সুনির্দিষ্ট এক নিয়মে। বিজ্ঞান আরো তথ্য দিচ্ছে যে, বংশগতির এই সুত্রটি প্রতিটি নবজাতক লাভ করে তার পিতা ও মাতার প্রজনন-কোষ থেকে। যে মুহূর্তে পুরুষের বীর্য মাতৃজরায়ুতে নিক্ষিপ্ত হয়, সেইমুহূর্ত থেকেই বংশগত উত্তরাধিকার নির্ধারণের কাজটি শুরু হয়ে যায়। প্রথম পর্যায়ে এই কাজটি শুরু হয় ভ্রূণের একান্ত প্রাথমিক স্তরে (গর্ভধারণের ২ মাসের মধ্যে); এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজটি শুরু হয় ভ্রূণের ২ মাস বয়সের পরে। (প্রথম স্তরে জণকে বলা হয় ‘এমব্রাইও’; দ্বিতীয় স্তরে ভ্রূণের বৈজ্ঞানিক নাম হল, ‘ফিটাস’। এই দুই স্তরে বা পর্যায়েই নির্ধারিত হয়ে যায় গর্ভস্থ শিশু পিতামাতা থেকে কি রকম দৈহিক গঠন-কাঠামো লাভ করবে? অর্থাৎ শিশুর ভবিষ্যৎ চেহারা-সুরত কি রকম হবে, পিতামাতা থেকে কতটা আলাদা হবে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মানুষের দেহ-কাঠামো তথা অবয়বের ক্ষেত্রে এই যে পরিবর্তন কিংবা সংশোধন –যাই বলা হোক, তাই কিন্তু সুনির্দিষ্ট একটা রূপ লাভ করে সন্তান জন্মগ্রহণের পর। শুধু তাই নয়, প্রতিটি নবজাতকের দেহের গঠন-কাঠামোগত এই সংশোধন পরিবর্তন তথা রূপান্তরের কাজটা চলে তার গোটা শৈশব জুড়ে– শরীরের বাড়ন্ত অবস্থা অব্যাহত থাকা পর্যন্ত।
পিতামাতার নিকট থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার সত্ত্বেও সন্তানের এই যে দেহগত আলাদা বৈশিষ্ট্য আলাদা চেহারা, তার কারণ কি? এ বিষয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে এমন একটি উপাদান, যা ‘জিন’ নামে খ্যাত।