যাহোক, প্রচলিত রয়েছে, যীশুর জন্ম হয়েছিল ‘আগস্ট-সেপ্টেম্বর’-এর কোন একসময়। সেক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের ভ্রান্তির পরিমাণ সম্ভবতঃ তিন-চার মাসের। কিন্তু দিন-মাস নিয়ে মতান্তর নয়, প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে গবেষকদের গুরুতর মতপার্থক্য রয়েছে সংশ্লিষ্ট বছর সম্পর্কে। পণ্ডিতদের মতে, যীশুর জন্ম চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে একাদশ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কোন একসময়ে। পণ্ডিতরা এর স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে একটি তারার কথা এবং তিনজন পূর্বদেশীয় পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করেছেন। এই পণ্ডিত তিনজন ‘মর্মজ্ঞ মহাত্মা’ (Magi), সম্ভবতঃ ইহুদী। লক্ষণ গণনা করে তাঁরা নবজাতক যীশুর দর্শন পান তারকা চিহ্নিত পথ ধরে এসে। যে তারকাটি লক্ষ্য করে তাঁরা পথ চলছিলেন পূর্ব থেকে পশ্চিমে, দক্ষিণে বেথেলহেমে এসে তা একটি পান্থশালায় থামে। তখন যে উজ্জ্বল তারাটির কথা বলা হয়েছে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে তাকে হ্যালির ধূমকেতু বা ওইরকম কোন ধুমকেতুকেই বলা হয়েছে।
মথি লিখিত সুসমাচারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, যীশুর জন্মের পরে পূর্বদেশ থেকে একদল দৈবজ্ঞ গুণী জেরুজালেমে এসে দেখা দিলেন। তারা সেখানে এসে খোঁজ করতে লাগলেন, ইহুদীদের যিনি রাজা হবেন তিনি কোথায় জন্মেছেন? পূর্বাকাশে তারা তার জন্ম-তারা উঠতে দেখেছেন, তাই তারা তাকে অর্ঘ্য নিবেদন করতে এসেছেন। কথাটা পরম্পরাগতভাবে যখন জুডিয়ার রাজা হেরোদের কানে উঠল তখন তিনি বেশ খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত হলেন এবং তিনি সকল প্রধান পুরোহিত ও ধর্মগুরুদের সম্মিলিত করে জিজ্ঞেস করলেন, প্রতি ত্রাণকর্তা (খ্রিস্ট) কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন?
তাঁরা পুঁথিপত্র ঘেঁটে জানালেন, শাস্ত্রে আছে তিনি জুডিয়ার বেথেলহেমে জন্মাবেন (২: ৩-৫)। তখন রাজা হেরোদ পূর্বদেশ থেকে আগত সেই দৈবজ্ঞ গুণীদের নিজের কাছে ডেকে এনে গোপনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনে নিলেন, সর্বপ্রথম কবে তারা পূর্বাকাশে সেই তারা উঠতে দেখেছেন। তারপর তাদের বেথেলহেম শহরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, আপনারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখুন। খোঁজ পেলেই আমায় এসে জানাবেন। তাহলে আমিও সেখানে গিয়ে তাকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসবো।
রাজার আদেশ শুনে গ্রহাচার্যেরা বেথেলহেমের দিকে পা বাড়ালেন। আশ্চর্য, যে তারাটি তারা পূর্বাকাশে দেখেন, সেই তারাই এখন তাদের যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। অবশেষে, যীশু যে জায়গায় জন্মেছিলেন সেই জায়গার ঠিক মাথার উপর তা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। দৈব মর্মজ্ঞরা বুঝলেন, তারা ঠিক জায়গায় পৌঁছেছেন। খুশি হয়ে তারা ঘরের ভেতর ঢুকতেই নবজাতক শিশুকে তার মায়ের কোলে দেখতে পেলেন, পিতা যোসেফ কাছেই দাঁড়িয়ে। তাদের সবাইকে প্রণিপাত করে তাঁরা গাটরি-পাটরা খুলে নানারকমের দামী দামী উপহার সামগ্রী বের করে শিশু-যীশুকে নিবেদন করলেন।
তারপর সেইরাতেই তাঁরা স্বপ্নে প্রত্যাদেশ পেলেন, তারা যেন আর হেরোদের কাছে ফিরে না যান। আদেশ শুনে তারা আর দেরি না করে অন্য পথ ধরে স্বদেশে ফিরে গেলেন। ওদিকে রাজা হেরোদ যখন বুঝতে পারলেন দৈবজ্ঞরা তাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে, তখন রাগে তিনি একেবারে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সেই পণ্ডিতদের নিকট বিশেষ করে যে সময় জেনে নিয়েছিলেন সে অনুসারে দু’বছর ও তকম বয়সের যত বালক বেথেলহেম ও তৎসীমার মধ্যে ছিল, লোক পাঠিয়ে সেসব শিশু বালকদের নির্বিচারে হত্যা করল (২: ১৬)।
ফলে, অনেক নিঃস্পাপ শিশুর মৃত্য হল। কিন্তু জল্লাদদের হত্যাকাণ্ড শুরুর পূর্বেই মরিয়মের বাগদত্ত স্বামী যোসেফ স্বপ্নে প্রত্যাদেশ পান, কালবিলম্ব না করে সে যেন শিশুটিকে আর তার মাকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে যান এবং যতদিন না তাদেরকে ফিরতে বলা হয়, ততদিন যেন সেখানেই থাকেন। এভাবে, শিশু যীশু যোসেফ কর্তৃক তার মাকে নিয়ে মিসরে পালিয়ে যাওয়ায় ওই নির্বিচার হত্যার হাত থেকে রক্ষা পান।
কিন্তু, ইতিহাসের বিবরণ মানতে গেলে, পৃথিবীর সর্বত্রই ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নিয়ে এমন অনেক কথা কাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে, যা মূলত ইতিহাস নয়। রাজা হেরোদের নির্বিচারে শিশু হত্যার বিষয়টিও একই। কারণ, রাজা হেরোদের অনেকরকম হত্যাকাণ্ডের কথা, তার বহু অপকীর্তির কাহিনী ঐতিহাসিকরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, কিন্তু ওরকম একটি বিনাবাছবিচারে পাইকারী হারে নিষ্পাপ শিশুহত্যার কথা কোন বইয়ের পাতায় কিংবা কোন দলিল-দস্তাবেজে কখনো দেখা যায় না। তবে, হেরোদ যে চরিত্রের লোক ছিলেন তাতে তার পক্ষে ওরকম একটি হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান করানো কেমন কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয় বলেই বোধহয় মথির কাহিনীতে জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে, জুডিয়ার সিংহাসনে বসার আগের সবকথা বাদ দিলেও, ঐতিহাসিক উক্তি অনুসারে ইহুদীদের রাজা হয়ে বসার পর হেরোদের এমন একটি দিন যায়নি, যেদিন কেউ-না-কেউ তার হাতে খুন না হয়েছেন। তার ওই আসুরিক কাণ্ড থেকে তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কেউই বাদ যায়নি। এক শ্যালক, দুই ভগ্নিপতি, এক স্ত্রী, সেই স্ত্রীর গর্ভজাত দুই পুত্র, এক শ্বাশুড়ি, দুই দাদা শ্বশুড় সবাই তার হাতে একে একে নিহত হন। এমনকি মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগেও তার দশ রানীর এক রানীকে ও আরেক রানীর গর্ভজাত পুত্রকে তিনি হত্যা করার আদেশ দেন।