“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি তোমাদিগকে গঠন করিয়াছেন কর্দম হইতে।”-সূরা ৬ (আনআম, আয়াত ২ (সূত্র নং ৫) :
মানব পরিগঠন প্রসঙ্গে কর্দম (আরবী–তীন) শব্দটি কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। এর দ্বারা মানুষ যেসব উপাদানে পরিগঠিত তা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেমন :
“(আল্লাহ) মানবসৃষ্টির সূচনা করিয়াছেন কর্দম হইতে।”–সূরা ৩২ (সাজদা), আয়াত ৭ (সূত্র নং ৬) :
এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় তাহল, কোরআন ‘তীন’ বা কর্দম’ থেকে মানবসৃষ্টির সুচনার কথা বলছে। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, সূচনা থেকে ‘শেষ পর্যন্ত এই সৃষ্টির আরো পরবর্তী-পর্যায় বিদ্যমান।
“আমরা তাহাদিগকে গঠন করিয়াছি আঠালো কর্দম হইতে।”–সূরা ৩৭ (সাফফাত), আয়ত ১১ (সূত্র নং ৭) :
এই আয়াতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন কোন তথ্য তেমন না থাকলেও, আলোচনার সম্পূর্ণতার জন্য এটি উদ্ধৃত করা হচ্ছে। বলা অনাবশ্যক যে, এখানে মানবসৃষ্টির কথাই বলা হয়েছে।
“(আল্লাহ্) গঠন করিয়াছেন মানুষকে কর্দম হইতে মৃৎশিল্পের মত করিয়া।”–সূরা ৫৫ (রহমান), আয়াত ১৪ (সূত্র নং ৮) :
এই বক্তব্যে আভাস পাওয়া যায় যে, মানুষকে মডেল বা নমুনা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে। পরের আয়াতেও এর উল্লেখ দেখতে পাওয়া যাবে।
“আমরা মানুষকে গঠন করিয়াছি কর্দম হইতে নকশাকাটা নরম মাটি হইতে।”–সূরা ১৫ (হিজর), আয়াত ২৬ (সূত্র নং ৯) :
(হামায়েম মাসনুন-এর আরেক অর্থ ও পচা-গলা কাদামাটি–সুদীর্ঘ সময়কালের যার চেহারা-সুরত পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে।)
এই একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে একই সূরার (হিজর) ২৮-৩৩ আয়াতেও।
“আমরা গঠন করিয়াছি মানুষকে কাদামাটির বিশুদ্ধ সারভাগ হইতে।”–সূরা ২৩ (মুমেনুন), আয়াত ১২ (সূত্র নং ১০) :
আরবী ‘সুলালাত’ শব্দের অর্থ ‘বিশুদ্ধ সারভাগ’–যার দ্বারা কোন কিছু থেকে তার সার-নির্যাস নির্গত করা বুঝায়। এই ‘সুলালাত’ শব্দটি কোরআনের অন্যত্রও ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেখানে মানুষের বংশধারা সৃষ্টিতে মানব-বীর্যের সারভাগ বা নির্যাসের কথা বুঝানো হয়েছে। আর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, মানুষের তরল বীর্যের একটিমাত্র জীবকোষ, যা সাধারণত শুক্রকীট নামে পরিচিত–সেই একটিমাত্র জীবকোষই মানুষের বংশধারা বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে (‘কর্দমের সারভাগ’ বলতে সেইসব রাসায়নিক উপাদানকে বুঝানো হয়েছে যেসব উপাদান আসে পানির সারনির্যাস থেকে এবং যেসব উপাদান কাদার মূল উপকরণ হিসেবে কাজ করে)।
কোরআন পানিকে সকল জীবনের ‘আদি উৎস’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। সেই পানি যে মানবসৃষ্টিতেও অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল–সে কথাটাই বর্ণিত হয়েছে নিম্নলিখিত বাণীতে। যথাঃ
“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি মানুষকে পানি হইতে গঠন করিয়াছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন বংশধারা (পুরুষের মাধ্যমে) এবং আত্মীয়তার ধারা নারীদের মাধ্যমে।”-সূরা ২৫ (ফোরকান), আয়াত ৫৪ (সূত্র নং ১১)
কোরআনে অন্যত্র যেমন, এখানেও তেমনি পুরুষ বলতে অনেকে আদমকে বুঝে থাকেন। পক্ষান্তরে, কোরআনের অনেক আয়াতে নারীর সৃষ্টি সম্পর্কেও বর্ণনা রয়েছে। যেমন :
“(আল্লাহ) সেই একক সত্তা যিনি গঠন করিয়াছেন তোমাদিগকে এক ব্যক্তি হইতে এবং তাহা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন তাহার স্ত্রী।”–সূরা ৪ (নিসা), আয়াত ১ (সূত্র নং ১২) :
একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ৭নং সূরার (আরাফ) ১৮৯ নং আয়াত এবং ৩৯ নং সূরার (জুমার) ৬নং আয়াতে। এ ছাড়াও ৩০নং সূরার (রুম) ২১ নং আয়াতে এবং ৪২নং সূরার (শূরা) ১১ নং আয়াতে একইবিষয়ের সূত্র টানা হয়েছে একইভাবে।
[এই স্থানে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। (১) সাধারণভাবে বলা হয়, পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকসময় কোরআন-হাদিসের বক্তব্য হিসেবেও এই ধারণাটাকে চালিয়ে দেয়া হয়। মূলত, এ বক্তব্য বাইবেলের (দেখুন, পুরাতন নিয়ম, ২ অধ্যায়, বাণী এবং ২২)। সেখানে বলা আছে : “সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন” ইত্যাদি। অথচ, বোখারী শরীফের ‘বিবাহ’ অধ্যায়ে, বলা আছে, শেষনবী (দঃ) বলেছেনঃ
“স্ত্রীলোকেরা পাঁজরার (হাড়ের) মত; যদি তোমরা তাকে সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙে যাবে–সুতরাং, বাঁকা অবস্থায় তা থেকে ফায়দা গ্রহণ কর।” {আরবীসহ হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণিত এই হাদিসটির জন্য দেখুন, সহী আল-বোখারী ৫ম খণ্ড, প্রকাশনা–মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আধুনিক প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৭০।} এখানে কোথাও পুরুষের পাঁজরা থেকে নারী সৃষ্টির কথা বলা নেই; এমনকি হযরত আদম (আঃ) কিংবা বিবি হাওয়ার কথাও নেই। বরং সাধারণভাবে সকল কালের স্ত্রী-জাতির বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে।
(২) কোরআনে যে ‘নাফসেন ওয়াহেদাতেন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, ডঃ মরিস বুকাইলি তার অর্থ করেছেন–সিঙ্গল পার্সন বা এক ব্যক্তি বলে। মোহাম্মদ মারমাডিউক পিকথল তাঁর জগদ্বিখ্যাত “দি মিনিংস অব দি গ্লোরিয়াস কোরআন’ এ এর অর্থ করেছেন ‘সিঙ্গল সোল’ বা ‘একক আত্মা’। আল্লামা ইউসুফ আলীও তার ‘দি হোলি কোরআনে’ সূরা নিসার ১নং আয়াতের টীকায় এই অর্থ সমর্থন করেছেন। এই নাফসেন ওয়াহেদাতেন-এর আরেক অর্থ ‘অভিন্ন সত্তা” বা ‘একটি প্রাণ’ অথবা একটি ‘জীবকোষ’ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে, উপরে উদ্ধৃত আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে: