এক. ডারউইনের থিওরি, যেখানে বলা হয়েছে, মানুষের আদি উৎস হচ্ছে, বানর অর্থাৎ বানরই রূপান্তরের মধ্যদিয়ে মানুষে পরিণত হয়েছে এবং
দুই. দুনিয়াতে মানুষ আবির্ভূত হয়েছে মানুষ হিসেবেই এবং আবির্ভাবের কাল থেকেই নানাপরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্যদিয়ে মানুষ তার বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। তাছাড়াও, মানুষের সেই রূপান্তর শুধু তার জ্ঞান-বুদ্ধিগত নয় এবং তার শারীরিক গঠন-কাঠামোর দিক থেকেও হয়েছে কার্যকর।
উল্লেখ্য যে, কোরআনের বহুসংখ্যক বাণী ও বক্তব্য মানুষের দৈহিক রূপান্তরের বিষয়টা সমর্থন করে বটে; কিন্তু এসব বাণী ও বক্তব্যে কোথাও বলা হয়নি যে, মানুষ বানরের বংশধর। বলাই বাহুল্য যে, ‘মানুষ বানরের বংশধর’–এই ধারণাটা সঙ্গত কারণেই মুসলিম, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয়বোধ ও ভাবাবেগকে আহত করে। কোরআনের মত একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আসমানী কিতাবে এই ধরনের কোন ভিত্তিহীন বিষয় এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অপ্রমাণিত কোন তথ্যের স্থানলাভের ধারণা একান্তই অবান্তর।
৩২. কোরআনের মতে মানুষ, মৃত্তিকা ও পানি
নিচে কোরআনের যে দুটি আত উদ্ধৃত করা হচ্ছে, তাতে দেখা যাবে মানবজীবন মাটির সঙ্গে একান্তভাবে সম্পৃক্ত। যথা :
“বরং আল্লাহ তোমাদিগকে উদ্ভূত করিয়াছেন ভূমি হইতে উদ্ভিদের ন্যায়। অতঃপর তিনি ইহাতে তোমাদিগকে ফিরাইয়া লইবেন, এবং তিনি তোমাদিগকে সেখান হইতে বাহির করিবেন–এক (নতুন)। জাত হিসেবে।”–সূরা ৭১ (নূহ), আয়াত ১৭ ও ১৮ (সূত্র নং ১) :
“এই (জমিন) হইতেই আমরা তোমাদিগকে পরিগঠিত করিয়াছি, এবং ইহাতেই তোমাদিগকে ফিরাইয়া লইব এবং ইহা হইতেই তোমাদিগকে বাইর করিব অন্য সময়ে।”-সূরা ২০ (ত্বাহা), আয়াত ৫৫ (সূত্র নং ২) :
এই আয়াতে মাটি থেকে মানুষের বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, মানুষ পুনরায় এই মাটিতেই ফিরে যাবে এবং সেইসাথে এখানে এই ধারণাও দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্ শেষবিচারের দিনে এই মাটি থেকেই পুনরুত্থান ঘটাবেন। বাইবেলেও একই আধ্যাত্মিক অর্থে ও তাৎপর্যে অনুরূপ বক্তব্যই রয়েছে।
পাশ্চাত্যে (এবং অন্য দেশেও) আরবী ‘খালাকা’ শব্দের তরজমা করা হয় সাধারণত ‘টু ক্রিয়েট’ বা সৃষ্টি করা–এই ক্রিয়াবাচক শব্দ দিয়ে। লক্ষণীয়, কাজিমিরিস্কির সুবিখ্যাত অভিধানে এই ‘খালাকা’ শব্দের আদি বা মূল অর্থ নিম্নমরূপঃ
‘কোন জিনিসকে সমানুপাত বা সৌষ্ঠব দান করা অথবা কোন কিছুকে সমানুপাতে বা সমমাত্রায় নির্মাণ করা।’
সুতরাং, এখানে ‘খালাকা’ শব্দের অর্থ যদি শুধু সৃষ্টি করা বলে উল্লেখ করা হয়, তাহলে এই অর্থের একান্ত সরলীকরণ করা হয় মাত্র। আর এভাবে ‘খালাকা’ শব্দের অর্থ যখন শুধু সৃষ্টি করা লেখা হয় বা বলা হয়, তখন তাতে শুধু সৃষ্টির কাজটাকেই বুঝায় ও নির্মাণকর্মে অনুপাত ও মাত্রা প্রদান এবং সৌষ্ঠবদানের কথাগুলো উহ্যই থেকে যায়। এ কারণেই ‘খালাকা’ শব্দের দ্বারা যা-কিছু বলা হয়েছে–সেই অর্থই শুধু তাকে তার মূল অর্থের কাছাকাছি নিতে পারে। এ কারণে এই শব্দটির প্রাচীন আরবী ব্যবহারের দিকে দৃষ্টি রেখেই প্রায় সব অনুবাদে খালাকা’ শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে ‘টু ফ্যাসন’ বা ‘সৌষ্ঠব দান’, ‘পরিগঠন’ কিংবা শুধু ‘গঠন’ শব্দের দ্বারা।
মানুষ মৃত্তিকা থেকে পরিগঠিত–কোরআনের এই বক্তব্যের সকল আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অটুট রেখেও বলা চলে, এই তাৎপর্যের দ্বারা আধুনিক যুগে মানুষের দেহ-গঠনের যেসব রাসায়নিক উপাদানের কথা বলা হয়, সেই অর্থও একেবারে খারিজ হয়ে যায় না। (মানবদেহ পরিগঠনের প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এই উপাদান বা উপকরণ যাই বলা হোক, তা কিন্তু মাটির সারনির্যাস থেকেই পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া, এসব উপাদান বা উপকরণ কখনো নিমূল হয় না বা হারিয়ে যায় না। যেমন, অ্যাটমিক উপাদান যেগুলো মলিকুল তৈরি করে থাকে। অন্যকথায়, যেসব উপাদান ও উকপরণে মানবদেহ পরিগঠিত সে-সব কমবেশি মৃত্তিকায় বিদ্যমান।)
যে-কালে কোরআন নাজিল হয়েছিল, তখনকার মানব-সমাজকে বুঝাবার জন্য তাদের মেধা ও জ্ঞানের উপযোগী করে মানুষ মৃত্তিকা দ্বারা পরিগঠিত’ বলে যে কথাটা বলা হয়েছিল, সে কথাটাই এখন এভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক গবেষণায় সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অর্থাৎ, মানবদেহ পরিগঠিত হয়েছে মৃত্তিকার সারনির্যাস বা মধ্যস্থিত উপাদান সহযোগে। কোরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতে এ কথাটা আরো স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে এবং সেখানে মানবদেহ পরিগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান ও উপকরণকে আখ্যায়িত করা হয়েছে নানাভাবে। যথা :
“তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের উদ্ভব ঘটাইয়াছেন জমিন হইতে।”–সূরা ১১ (হুদ), আয়াত ৬১ (সূত্র নং ৩) :
(জমিন—মৃত্তিকা–আরবী আরদ, ইংরেজি আরথ) এই আরদ্ বা আরথ তথা মৃত্তিকার কথাটাই পুনরায় উল্লিখিত হয়েছে ৫৩নং সূরার (নজম) ৩২নং আয়াতে।
“আমরা তোমাদিগকে গঠন করিয়াছি (বা সৌষ্ঠবদান করিয়াছি) মাটি হইতে।”–সূরা ২২ (হজ্ব), আয়াত ৫ (সূত্র নং ৪) :
মানুষ যে মৃত্তিকা দ্বারা পরিগঠিত, সেই কথাটা এখানে আবারও উল্লিখিত হয়েছে ১৮ নং সূরার (কাহাফ) ৩৭নং আয়াতে; ৩০নং সূরার (রুম) ২০নং আয়াতে; ৩৫ নং সূরা (ফাতের) ১১নং আয়াতে এবং ৪০ নং সূরার (মুমেন) ৬৭ নং আয়াতে।