এ কথা অবশ্য ঠিক যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এসব বর্ণনা কোরআনের সুনির্দিষ্ট কোন স্থানে পাওয়া যাবে না। ১৯৭৬ সালে এ বিষয়ে ড. মরিস বুকাইলির যে বিশ্লেষণাত্মক গবেষণা-নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা প্রণয়নের বেলায় তিনি গোটা পাশ্চাত্যজগতে প্রকাশিত কোরআন সম্পর্কিত নানা গ্রন্থ মন্থন করেও এ বিষয়ে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। খুঁজে-পেতে শেষপর্যন্ত আরবি ভাষায় প্রকাশিত কিছু পুঁথি-পুস্তক পেয়েছিলেন। সেগুলো পড়লেই বুঝা যায়, এসব বিষয়ে কোরআনের বক্তব্য কি, বিজ্ঞান বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু দুই-একজন গবেষক লেখক তা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন মাত্র। কিন্তু ‘ওভার অল স্টাডি’ বা সামগ্রিকভাবে গবেষণা বলতে যা বুঝায় তার হদিস কোথাও মেলেনি।
বিষয়টা অবশ্য সহজও নয়। কেননা, এ ধরনের কোন বিষয়ে তেমন গভীর কোন গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় হল, আধুনিক বিজ্ঞানের সুবিস্তৃত শাখা-প্রশাখার বিশদ জ্ঞান ও সুগভীর অনুসন্ধান। এদিকে ইসলামী তত্ত্ববিদ বা ধর্মবিশারদ হিসেবে যারা পরিচিত, তারা বেশিরভাগই মলত, ধর্মীয় জ্ঞান-প্রজ্ঞাসম্পন্ন ভাষাবিদ পণ্ডিত। কিন্তু ইসলামীতত্তের বিষয়ে যে-কেউ যতই বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ পণ্ডিত বা বিদগ্ধসুধীজন হোন-না-কেন, তিনি তাঁর গবেষণা প্রকাশনায় কোরআনের বিজ্ঞান-সম্পর্কিত বিষয়ে ঠিক একজন বিজ্ঞানী গবেষকের মত গুরুত্ত্ব আরোপ করবেন, এটা আশা করা চলে না। কথাটা পাশ্চাত্যের ইসলামীতত্ত্ববিদদের বেলায় বেশি খাটে।
বস্তুত, এ কাজের জন্য প্রয়োজন এমন একজন আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু মানুষ যিনি একাধারে বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখার সর্বাধুনিক তথ্যজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং এই সঙ্গে আরবী ভাষায়ও সমান ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন। এ রকম কোন মানুষ যখন মূল আরবীতে কোরআন পড়বেন, তখন তার পক্ষেই শুধু অনুধাবন করা সম্ভব হবে যে, কোন্ বিষয়ে কোরআনে সঠিক অর্থে কোন্ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে; আর আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক জ্ঞান-গবেষণা সে সম্পর্কে কি তথ্য পরিবেশন করছে। এ রকম অনুসন্ধানী মানসিকতা নিয়ে যখন কেউ এগিয়ে আসবেন শুধু তখনই তাঁর পক্ষে এতদুভয়ের মধ্যে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে : তার আগে নয়।
কোরআনে প্রকৃতি ও বিজ্ঞান-বিষয়ক এ-সব বাণী ও বক্তব্যের উপস্থিতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, কোরআন যে-কালে নাজিল হয়েছিল তখন এসব বিষয় সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না। হাজার-দেড় হাজার বছর পরে এসে শুধু আধুনিক বিজ্ঞানই নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা-বিশ্লেষণ ও আবিষ্কার-অনুসন্ধানে এসব বিষয়কে মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছে। এখানেই যে বিষয়টা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাহল : প্রায় দেড় হাজার বছর আগেকার কোরআনের বাণী বক্তব্যে কিভাবে এমন সব বিষয় স্থান পেল এবং কিভাবে সে-সব বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত তথ্য পরিসংখ্যানের সাথে এত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারল?
এই পর্যায়ে একটা কথা সবিনয়ে নিবেদন না করে পারা যায় না। তাহল, কোরআনের প্রচলিত বিভিন্ন অনুবাদ ও তাফসীরসমূহে এসব বিষয়ে যে-সব অর্থ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য-বর্জিত। ফলে, অনেকক্ষেত্রে ওইসব অর্থ ও ব্যাখ্যা হয়ে পড়েছে অগভীর–এমনকি বিভ্রান্তিকর। অনেক বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ তফসীরকার মোহম্মদকে (দঃ) একজন সুদক্ষ চিকিৎসক হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। কেউ কেউ কোরআনের মধ্যে খুঁজেছেন নানান রোগ-ব্যাধীর সমাধান। প্রকৃতপক্ষে, কোরআনে যা রয়েছে তা হল, স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্য-অখাদ্য-সম্পর্কিত নির্দেশ। যেমন, মদ ইত্যাদি মাদকদ্রব্যের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এতে রয়েছে। রমজান মাসে রোজা রাখার নির্দেশটাও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত বলে ধরে নেয়া যায়। কোরআনে মধুর উপকারিতার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ব্যাধি নিরাময়ের কথা সেখানে নেই।
৩০. কোরআনের আলোকে জীবনের সূচনা
ঠিক কোন্ উৎস থেকে পৃথিবীতে জীবন বা প্রাণের সূচনা ঘটেছে কোরআনে এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব বিদ্যমান। এই পরিচ্ছেদে কোরআনের যে সব বাণী ও বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেব, তাতে দেখা যাবে, জীবনের সূচনা ঘটেছে পানি থেকে। প্রথম উদ্ধৃত বাণীতে বিশ্বসৃষ্টির কথাও উল্লিখিত হয়েছে। যথা :
“অবিশ্বাসীরা কি ভাবিয়া দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একত্রে মিলিত ছিল? পরে, আমরা তাহাদের পৃথক করিয়াছি এবং আমরা প্রতিটি জীবন্ত জিনিসকে বাহির করিয়াছি পানি হইতে? তাহার পরেও কি তাহারা বিশ্বাস করিবে না?”-সূরা ২১ (আম্বিয়া), আয়াত ৩০ :
“একটা কিছু থেকে অন্য একটা কিছু সৃষ্টি করার” এই ধারণা বা মতবাদ সম্পর্কে সন্দেহের কিছু থাকতে পারে না। এখানে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে, তার একটা অর্থ এই হতে পারে যে, জীবন্ত সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে পানির দ্বারা (অর্থাৎ, সেই সৃষ্টির কাজে পানি হল অপরিহার্য উপাদান); অথবা এর আরেক অর্থ এই হতে পারে যে, প্রতিটি জীবন্ত কিছুর উৎপত্তি ঘটেছে পানি থেকেই। তবে, যে অর্থই করা হোক, দুটি অর্থই কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠিত-সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।