প্রথমত, সকলেই অবগত আছেন, মোহাম্মদের (দঃ) জীবদ্দশাতেই কোরআনের সূরাসমূহ লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ করে ধরে রাখা হয়েছিল। তখন কাগজের প্রচলন তেমন ছিল না। ফলে, অবতীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওহী লেখকদের মাধ্যমে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল নরম পাথরের টুকরায়, চামড়ায়, হাড়ে ও তখনকার প্রচলিত অন্যান্য উপকরণে। বিভিন্ন আয়াতেও কোরআনকে স্পষ্ট ভাষায় লিখিত ‘কিতাব’, ‘উন্মুক্ত গ্রন্থ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা উল্লেখ করা হয়েছে হিজরতের আগে ও পরে অবতীর্ণ বিভিন্ন সূরায়।
দ্বিতীয়ত, লিখিতভাবে সংরক্ষণ ছাড়াও কোরআন সংরক্ষণের অপর যে ধারাটি প্রথম থেকেই চালু রয়েছে, তা হেঞ্জ বা মুখস্থকরণের ধারা। গোটা কোরআন, সবাই জানেন, বাইবেল পুরাতন নিয়ম (তাওরাত ও জবুর) থেকে আকারে অনেক ছোট এবং নতুন নিয়মের (ইঞ্জিল) তুলনায় সামান্য কিছু বড়। যেহেতু, গোটা কোরআন সুদীর্ঘ কুড়ি বছরেরও অধিককাল ধরে ধারাবাহিকভাবে নাজিল হয়, সে কারণে মোহাম্মদের (দঃ) সঙ্গী-সাথীদের দ্বারা একটি একটি করে সমস্ত সূরা মুখস্থ করা হয়েছিল সহজতর।
যাহোক, লিপিবদ্ধকরণের পাশাপাশি কোরআন মুখস্থ বা হেফজ করার এই ধারাটিও কোরআনকে সকল কম হস্তক্ষেপমুক্ত অবস্থায় তার সেই আদি ও অকৃত্রিমস্বরূপে সংরক্ষণ করে আসছে। এভাবে গোড়া থেকেই কোরআন সংরক্ষণের দুটি পৃথক ধারা জারি রয়েছে। লিখিত ও মুখস্থ এই দ্বিবিধ সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কোরআনের সঠিকত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। লিখিত কোরআনের যেকোন ত্রুটি হেজকারীদের দ্বারা তাৎক্ষণিকভাবেই সংশোধিত হওয়ার অবকাশ রয়েছে।
২৯. ধর্মীয় ও জাগতিক তাৎপর্যবহ কোরআন
অবশ্য, এ কথা ভুললেও চলবে না যে, কোরআন মূলত একখানি ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং, কোরআনের সববাণী ও বক্তব্যে যদি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণা ও বিজ্ঞানের তত্ত্ব খুঁজতে যাই, তবে ভুল হবে নিঃসন্দেহে। বরং, কোরআনের বাণী ও বক্তব্যে পরম স্রষ্টার যে সৃষ্টিকুশলতা, প্রাকৃতিক বিধি-বিধানের রহস্যের যে বর্ণনা রয়েছে, তারমধ্যে যুগে যুগে মানুষের দৃষ্টিতে যতটা ধরা পড়েছে কিংবা মানুষের জ্ঞানের-আলোকে যতটা প্রতিভাত হয়েছে, শুধু ততটুকু তথ্যেরই পর্যালোচনা করা যায়। কোরআনের বাণী ও বক্তব্যে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের এই যে প্রতিফলন, আধুনিক যুগে সেই প্রতিফলনই একান্ত তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ধরা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কোরআনের যেসব বাণী ও বক্তব্য এতদিন যাবত ছিল অজ্ঞেয়, দুৰ্জেয় ও রহস্যময়, আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা ও আবিষ্কারে তার অনেক কিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এখন মানব-জ্ঞানের পরিসীমায় ধরা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোরআনের বাণীর এই বৈশিষ্ট্যই এখন বৈজ্ঞানিক-মনের কাছেও একান্ত বিস্ময়কর হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।
এ কথার দ্বারা অবশ্য এটা বুঝাও উচিত হবে না যে, মানবসৃষ্টি-সম্পর্কিত কোরআনের সকল কিছু, আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য-জ্ঞানের গবেষণা ও আবিষ্কারে আলোকিত ও বিশ্লেষিত হয়ে শেষ হয়েছে। সত্যি কথা, বলতে কি, মানব-সৃষ্টির বিষয়টা বাইবেল ও কোরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের আওতা-বহির্ভূত বিষয় হিসেবেই বিদ্যমান। এ কারণে, এখন যখন বাইবেলের নতুন নিয়ম (ইঞ্জিল) কিংবা কোরআন আমাদের জানায় যে, যীশুখ্রিস্ট অর্থাৎ হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম হয়েছিল বিনা পিতায়, তখন বিজ্ঞানের প্রতিবাদ এ সম্পর্কে তেমন সোচ্চার হতে পারে না। যদিও বিজ্ঞান জানে যে, শারীরবিজ্ঞানের নিয়মানুসারে কোন মানব সন্তানের পক্ষে বিনা পিতায় জন্ম হওয়াটা অসম্ভব। কারণ, পিতার বীর্য নিঃসৃত শুক্রকীট সন্তানকে শুধু জন্মই দেয় না, প্রতিটি নবজাতকই তার পিতার থেকে অর্ধেক জেনেটিক উত্তরাধিকারও লাভ করে থাকে। মূলত, বিজ্ঞান কোন অলৌকিকত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করে না; কেননা, অলৌকিকত্বের সংজ্ঞাই হচ্ছে–এমনকিছু, যা ব্যাখ্যার অতীত। এভাবে কোরআন ও বাইবেল যখন বলে যে, মানুষ পরিগঠিত হয়েছে মাটি থেকে, তখন সেই বক্তব্যে কার্যত ধর্মের একটি মৌলিক সত্য লাভ করে। যেখান থেকে আগমন, সেখানেই প্রত্যাগমন; যার শয়ান যেখানে, শেষ বিচারের দিনে তার পুনরুত্থান ঘটবে সেখান থেকেই।
কোরআনে ধর্মীয় তাৎপর্যমণ্ডিত বক্তব্য তো রয়েছেই; সেইসঙ্গে মানব সম্পর্কিত বক্তব্যের পাশাপাশি আরো এমনসব তথ্য ও বক্তব্য পাওয়া যায় যা একান্তভাবেই জাগতিক বা বস্তুগত। কোন বিজ্ঞানী যখন কোরআনের মত একটি ধর্মগ্রন্থে এ ধরনের একান্ত বাস্তব-জ্ঞানসম্মত তথ্য ও বক্তব্য পেয়ে যান, তখন তিনি চমকে উঠে থমকে না যেয়ে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে কোরআনে প্রাণের সৃষ্টি-সংক্রান্ত বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাণের আদি উৎস সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট বক্তব্য কোরআনে রয়েছে।
শুধু তাই নয়, মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারটা যে শারীরবিজ্ঞানের রূপান্তরের ধারায় সম্পাদিত হয়েছে, সে সম্পর্কেও কোরআনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে বিস্তারিত বর্ণনা। কোরআনে এই তথ্যও স্পষ্ট ভাষায় পরিবেশিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ মানুষকে নিজস্ব ইচ্ছানুসারে সুষমামণ্ডিত করেছেন। অনুরূপভাবে, আমরা কোরআনে আরো দেখা যায়, মানব-প্রজনন-সংক্রান্ত এমনসব সঠিক বর্ণনা, যার সঙ্গে শুধু আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণায় প্রাপ্ত সুপ্রমাণিত তথ্যজ্ঞানেরই তুলনা চলে।