সুতরাং, লুক বর্ণিত আলোচ্য তথ্যটি অবিশ্বাস্য হলেও প্রশ্ন জাগে : এমন ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণাদির প্রতিকূলে লুক কি উদ্দেশ্যে লোকসংখ্যা গণনার মত একটি ইতিহাস যীশুর জন্মকালে হয়েছিল বলে আবিষ্কার করলেন? এই আবিষ্কারের পিছনে বাধ্যবাধকতামূলক কোনো নেপথ্যকারণ (background) নিশ্চয় তাঁর ছিল। মনে হয়, যোসেফ মরিয়মকে নিয়ে তার গর্ভাবস্থাকালীন সময় শারীরিক দুর্বলতার চরমসীমায় বেথেলহেমের মত সুদূরবর্তী স্থানে এক দুঃসাধ্য ভ্রমণের ঝুঁকি কেন গ্রহণ করেছিলেন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই লুক এহেন নৈরাশ্যজনক অনুসন্ধান চালান এবং পরিণামে লোকসংখ্যা গণনার প্রকৃত ঘটনার বিষয়ে হোঁচট খান, যা তার আরোপিত তারিখের সাত বছর পরে সংগঠিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, জনসংখ্যা গণনা ও যীশুর জন্ম একইসময় ঘটেছিল এমন প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে তিনি ইচ্ছে করেই জনসংখ্যা গণনার তারিখ সাত বছর এগিয়ে দেন, যা প্রকৃত ঘটনার প্রায় সত্তর-আশি বছর পর ইতিহাস লিখতে গিয়ে সম্ভবত তিনি মনে করেন যে, দীর্ঘকাল পরে এ ধরনের ঐতিহাসিক ভ্রমণকাল নিরূপণের বিষয়টি কেউ আর বুঝবে না। এভাবে সাতবছর পরে সংঘটিত জনসংখ্যা গণনাকে যীশুর জন্মবর্ষে আরোপ করে লুক নিজে নিজে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন যে, যোসেফ কেন তার রুগ্ন স্ত্রীকে পূর্ণ গর্ভাবস্থায় ৭০ মাইল দূরবর্তী বেথেলহেম ভ্রমণের কষ্ট দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এভাবে লুক নিজের কাছে। ব্যাখ্যাদানে কৃতকার্য হয়েছেন।
কিন্তু তবুও একটি দুর্বোধ্য ব্যাপার থেকে যায়, যীশুর জন্মকালে যদি লোকসংখ্যা গণনার মতো প্রচলিত ইতিহাস থেকেই থাকে তবে লুক কেন বেথেলহেম ভ্রমণের মতো ইতিহাস আবিষ্কারে এত সচেষ্ট হলেন? কেনই-বা তিনি যোসেফকে নিয়ে মরিয়মের ওই কষ্টকর ভ্রমণে বাধ্য করালেন? মূলতঃ লুকের এই আবিষ্কার তার নিজের জন্যই অন্তরায় ছিল। কারণ, মরিয়মের পবিত্র আত্মায় গর্ভধারণের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বড় বড় আশ্চর্যজনক অলৌকিক ক্রিয়াসমূহ শুরু হয় এবং যীশুর জন্মপর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটতে থাকে। তিনি আশংকা করেন যে, যোসেফ ও মরিয়মের এই ভ্রমণের উপযুক্ত কারণ যদি প্রমাণ করা না হয়, তাহলে জনসাধারণের কাছে তারা ন্যায়সঙ্গতভাবেই দুর্বল বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত হবেন এবং জনসাধারণ স্বভাবতঃই বলবে যে, উক্ত গর্ভধারণের সময় এত অলৌকিক ক্রিয়াসমূহ প্রত্যক্ষ করার পরও যোসেফ লোকজনের সমালোচনা ও কুৎসা রচনার ব্যাপারে তখনও ভীত ছিলেন এবং উক্ত গর্ভধারণের ঘটনা ও পরবর্তী জন্মবৃত্তান্ত গোপন করার উদ্দেশ্যেই তারা নাসরত নগর ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু রূঢ় বাস্তব বিষয় ছিল, তারা অতি দূরবর্তী স্থানে বেথেলহেমের ভ্রমণ পরিগ্রহণ করেছিলেন বাস্তব ন্যায়সঙ্গত কারণে। লুক সম্ভবতঃ ভেবেছিলেন যে, জনসাধারণ বলতে পারে যে, উক্ত গর্ভধারণের অব্যাবহিত পরেই অলৌকিক কার্যকলাপ ও স্বর্গীয় চিহ্নাদি যদি সত্যিই সংঘটিত হয়ে থাকে তবে মরিয়মের গর্ভধারণ ও পরবর্তীতে যীশুর জন্মবৃত্তান্ত গোপন করার জন্য যোসেফ মরিয়মকে তার কায়িক দুর্বলাবস্থায় এই কঠিন ও ক্লান্তিময় ভ্রমণে বাধ্য করেছিলেন?
এ সকল কারণই যীশুর গর্ভে থাকাবস্থায় বড় বড় অলৌকিক ক্রিয়াসমূহ। আবিষ্কারের বিষয়টিই লুককে লোকসংখ্যা গণনা ও লোকসংখ্যা গণনাকালীন সময়ে মরিয়মকে বেথেলহেম যাওয়ার গল্প তৈরি করতে বাধ্য করে।
যদিও যীশুর জন্মসময়ে লোকসংখ্যা গণনা করা হয়েছিল এহেন তথ্য আবিষ্কার করা লুকের অপ্রয়োজন ছিল, সহজেই তিনি ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, মরিয়ম মন্দিরে থাকাকালীন যোসেফের সাথে বিয়ে হয়, যেহেতু যোসেফ নিজেও মরিয়মের সতীত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী ছিলেন এবং এ মর্মে তিনি পূর্বেই এক স্বপ্ন দেখেছিলেন (মথি, ১: ২০-২১) কিন্তু তিনি যেহেতু আশংকা করছিলেন, তাই তিনি অন্য লোকদেরকে এ ঘটনা বিশ্বাস করাতে সমর্থ হবেন না এবং লোকজনের তরফ থেকে কুৎসা রটনার ভীতিও পোষণ করতেন, তাই তিনি মরিয়মের গর্ভধারণের পূর্ণতৃপ্রাপ্তি লোক-সমাজে প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই তাকে সুদূরবর্তী স্থানে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু লুক তা করেননি। কারণ, সেক্ষেত্রে মরিয়মের গর্ভধারণের সময় বড় বড় অলৌকিক ক্রিয়া-সংঘটনের সকল গল্প চুরমার হয়ে যেতো। এভাবেই সমস্ত জটিলতার উদ্ভব হয়েছে এবং একটি আবিষ্কার আরেকটি আবিষ্কারকে সৃষ্টি করেছে।
যীশুর জন্মসন নিয়ে মতভেদ :
যীশুর জীবনী লেখক পৃথিবীখ্যাত বেঁনা বলেছেন, অগাস্টাস সিজারের রাজত্বকালে ৭৫০ রোমান অব্দে এবং খুব সম্ভবতঃ বর্তমান সভ্যজগতের সাল গণনার প্রথমবর্ষের কয়েক বছর আগে যীশু জন্মগ্রহণ করেন। অন্য বর্ণনায় আছে, রোম সম্রাট অকটোভিয়াস (সরকারি নাম অগাস্টস সিজার)-এর সময় সাঁইত্রিশ বছরকাল রাজত্ব করে ইহুদীদের রাজা হেরোদ সত্ত্বর বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যুর আগের বছর অথবা সেই বছরই উত্তর প্যালেস্টাইনের গালিলী প্রদেশের নাজারেথ শহরে যীশুর জন্ম হয়। তার জন্মের চার কি পাঁচ বছর পর থেকে তাঁর জন্মানোকেই উপলক্ষ্য করে প্রচলিত খ্রিস্টাব্দের গণনা আরম্ভ হয়েছে। আর সাধু লুকের বিবৃতি থেকে জানা যায়, বছর মাথাপিছু পোল ট্যাক্স বা জিজিয়া কর আদায়ের অভিপ্রায়ে লোকসংখ্যা গণনা করা হয় সেই বছরই যীশু জন্মগ্রহণ করেন। এই লোকসংখ্যা গণনার কাজ শুরু হয় ছয় খ্রিস্টাব্দে আর শেষ হয় সাত খ্রিস্টাব্দে। এই হিসেবে তখন যীশুর বয়স দশ কি এগারো বছর দাঁড়ায়। সুসমাচার রচয়িতা মথি ওই ঘটনাকেই দশ বছর এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। গোলমাল হয় দেখে, অনেকে আবার যীশুর জন্মসালকে দশবছর পিছিয়েও দেন। কিন্তু তাহলে সুসমাচারে বর্ণিত কালক্রমের প্রায় সবটাই ওলোট-পালোট হয়ে যায়।